প্রান্তিক জনপদ। সন্ধের মুখে যাত্রিবাহী শেষ বাস গঞ্জের টার্মিনাসে থামতেই হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। খানিক পরে ট্রেকার, অটোর ভিড় পাতলা হলে সন্তর্পণে বাস থেকে নেমে পড়েন ওঁরাও। তারপর, মফ্সসলের সেই বাসস্ট্যান্ডের গায়ে লেপ্টে থাকা ভাতের হোটেল-চায়ের দোকান কিংবা স্থানীয় রেগুলেটেড মার্কেটের চত্বরে কোনওক্রমে মাথা গুঁজে কয়েকটা দিন। কেউ বা আস্ত কয়েকটা বছর। ‘ছানু পাগলি’র মতো কেউ বা আমরণ। নদিয়ার সীমান্ত শহর করিমপুরে।
সংসারে, গ্রামে কিংবা শহুরে পাড়ায় ক্রমশ প্রান্তের দিকে কোণঠাসা হতে হতে শেষে দেশের প্রান্তে ঠাঁই হয় এই মনোরোগীদের। একটা টিকিট কেটে বাসে তুলে অচেনা গন্তব্যে পাঠিয়ে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দেওয়া, এমনটাই করছেন আত্মীয়-পরিজন। অন্য রাজ্যেও এমন হচ্ছে। কর্ণাটকের বন্দিপুর অভয়ারণ্য চিরে গিয়েছে যে জাতীয় সড়ক, বছর কয়েক ধরে সে পথে প্রায়ই দেখা মিলছে ঠিকানাহীন ভবঘুরের। স্থানীয় একটি মিশনারি হাসপাতাল সেই সব নামগোত্রহীন মানুষকে তুলে এনে সেবা শুশ্রূষা করেন। |
কিন্তু জঙ্গল পথে তাঁরা গেলেন কী করে? স্থানীয় পুলিশ কর্তা বি রেণুকা প্রসাদ বলছেন, “চোখের সামনে থেকে তাঁদের সরিয়ে দিতে ভবঘুরেদের বাড়ির লোকই ট্রাক চালকদের হাতে দশ-বিশ টাকা দিয়ে তাঁদের অজানা ঠিকানায় ঠেলে দিচ্ছেন।” অচেনা জঙ্গলে না-খেতে পেয়ে কিংবা বন্য পশুর থাবায় অচিরেই হারিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। সমীক্ষা বলছে সেই তালিকায় ওড়িশা, বিহার এমনকী এ রাজ্যও রয়েছে। মনোরোগীদের নিয়ে কর্মরত রত্নাবলী রায় বলেন, “হয় শিকলে বেঁধে রাখা, না হলে হাসপাতালে বন্দি, নয় অচেনা রাস্তায় বার করে দেওয়া, এ ছাড়া মনোরোগীদের নিয়ে কী করা যায়, বোঝে না বহু পরিবার।” ‘কেয়ার অফ করিমপুর’ যাঁরা রয়েছেন, কেমন আছেন তাঁরা?
নদিয়ার নাকাশিপাড়ায় ভবঘুরেদের নিয়ে প্রায় বিশ বছরের ঘর-সংসার মোসলেম মুন্সির। তাঁর ‘নির্মল হৃদয় সমিতি’তে পরিত্যক্ত, নাচার মানুষদের নিয়ে পরিবার গড়ে তুলেছেন মোসলেম। তাঁর ব্যাখ্যা: “করিমপুরে ভবঘুরেদের ভিড়টা একটু বেশিই। সীমান্তের শহর তো, দূর দূরান্তের বাসে চড়েও অনেকে এসে পড়েন। তবে অধিকাংশই সীমান্তের ওপার থেকে আসা মানুষ। ওপারের কাজিপুর বা দৌলতপুরে নেমে কাঁটাতারহীন সীমান্তের তোয়াক্কা না করে ওঁরা চলে আসেন করিমপুরে।” তিনি জানান, খিদের টানে গঞ্জ শহর করিমপুরে ভিড় করেন ওঁরা। “ওঁরা বড় স্নেহের কাঙাল। কেউ ভালবেসে এক কাপ চা দিলেও বড় খুশি হন।”
স্থানীয় একটি কিশোর সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক অশোক সাহা বলেন, ‘‘করিমপুরের ভবঘুরেদের উপরে আমি একটা সমীক্ষা চালিয়েছিলাম। ওঁদের ডাক নামও রয়েছে--মামা, নিত্য, ফোলা কাকা, শ্যামলাল, হারান। আমি জানি, ওঁদের কে সর্বক্ষণ ভাইয়ের কথা বলে, কে একের পর এক চিঠি লিখে চলেন অজানা ঠিকানায়। কে চায়ে চিনি বেশি খান, কে পছন্দ করেন বেকারির বিস্কুট।” তিনি জানান প্রত্যেককে ঘিরে এক-আধটা গল্পও রয়েছে।
বছরখানেক আগে এক অবাঙালি ভবঘুরে এসে হাজির হয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট হোটেলের সামনে রোজ গিয়ে সে হাঁক পাড়ত, ‘দোস্ত খানা মিলেগা?’ শহরে তার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘দোস্ত’। করিমপুরে সব্জি নিতে এসেছিল একটি ট্রাক। সেই ট্রাক চালক আচমকাই এক দিন দোস্তকে দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন। জানা গেল, দোস্ত আর কেউ নয়, বহুদিন আগে তাঁর হারিয়ে যাওয়া সহোদর।
হয়তো করিমপুরের ভবঘুরেরা অনেকেই সহৃদয় ব্যবহার পাচ্ছেন কিছু স্থানীয় মানুষের কাছে। কিন্তু তাতে কাটছে না অস্বস্তি। রত্নাবলীর কথায়, “খেতে-পরতে যদি বা পান, তবু এই মানুষগুলির চিকিৎসা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রয়োজন এঁদের পুনর্বাসন।”
সে ব্যাপারে এগিয়ে এসেছেন মোসলেম। কিন্তু চাইলেই তো আর পুনর্বাসন হয় না। সেই প্রক্রিয়াটা পুলিশ-আদালতের চক্রে এমনই জটিল, যে সুস্থ মানুষের পক্ষেও তা ভেদ করা প্রায় অসম্ভব।
দেশের প্রান্তিক শহর করিমপুরই এখন তাই বুক পেতে আগলে রেখেছে ভবঘুরেদের। |