পুস্তক পরিচয় ১...
আত্মসমীক্ষা শুরু হল, সেটাই ভাল
সৃষ্টি ও কৃষ্টি: বন্ধনহীন গ্রন্থি, বিকাশ সিংহ। আনন্দ পাবলিশার্স, ২৫০.০০
চুয়ান্ন বছর আগে ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী চার্লস পার্সি স্নো লিখেছিলেন একখানি বই। দ্য টু কালচারস অ্যান্ড দ্য সায়েন্টিফিক রেভলিউশন। বইটি আসলে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিখ্যাত ‘রিড লেকচার’-এর মুদ্রিত সংস্করণ। ওই বক্তৃতায় স্নো তুলে ধরেছিলেন সভ্যতার অগ্রগতির অন্তরায় এক সমস্যার কথা। পশ্চিমি বুদ্ধিজীবীরা, স্নো-র মতে, স্পষ্ট বিভক্ত সংস্কৃতির দুই শিবিরে। বিজ্ঞান এবং কলা। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি লিখেছিলেন, বহু বার তিনি উপস্থিত থেকেছেন এমন জমায়েতে, যেখানে প্রথাগত বিচারে সবাই বেশ উচ্চশিক্ষিত। এবং সবাই বিজ্ঞানীদের অশিক্ষা দেখে অবাক। এ হেন পরিস্থিতিতে আর সহ্য করতে না পেরে ওঁদের অনেককে জিজ্ঞাসা করেছেন, থার্মোডিনামিক্স-এর দ্বিতীয় সূত্রটা কী? উত্তরে স্নো পেয়েছেন এক শীতল নীরবতা। হায়, প্রশ্নটা তো ‘আপনি শেক্সপিয়ার পড়েছেন কি-না’-র সমতুল্য। কলা বিভাগের পণ্ডিতেরা বিজ্ঞানে অজ্ঞ, আর বিজ্ঞানীরা কলায় সংস্কৃতির এই প্রকোষ্ঠায়ন ব্রিটিশ সমাজের সর্বনাশ ডেকে আনছে বলে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন স্নো। বলা বাহুল্য, তিনি প্রথম স্পষ্ট করে বললেও, দুঃখটা তাঁর একার নয়, সমস্যাটাও নয় শুধু ব্রিটিশ সমাজের। আধুনিক যুগে এ সমস্যা বহু দেশের।
ভারতের তো বটেই। বিজ্ঞানের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের যেন আড়ি এখানে। অথচ, বিজ্ঞানের গবেষক এবং বহুকাল যাবৎ প্রশাসক হিসেবে বিকাশ সিংহ জানেন দুই প্রকোষ্ঠের প্রাচীর ভাঙা একটা জরুরি কাজ। সৃষ্টি ও কৃষ্টি: বন্ধনহীন গ্রন্থি ওই লক্ষ্যে তাঁর উদ্যমী প্রচেষ্টা। সাহিত্য আর বিজ্ঞানের তরফে জগতের সত্য আবিষ্কারের কাজে দৃষ্টিভঙ্গির ফারাকের যে শ্রেষ্ঠ নিদর্শন, রবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইন কথোপকথনের সেই বিখ্যাত কাহিনি বিকাশ অবশ্যই আলোচনা করেছেন। সাহিত্যের সত্য যে দ্রষ্টা-নির্ভর, আর বিজ্ঞানে যে তা দ্রষ্টা-নিরপেক্ষ, অন্তত ধ্রুপদী বিজ্ঞানের সেটাই যে মূল দাবি, সে সব ব্যাখ্যা করেছেন। তবে, সাহিত্য আর বিজ্ঞানের মোলাকাত এবং গোপন ঐক্য নিয়ে বিকাশের আলোচনায় বার বার এসেছে রবীন্দ্রনাথ-জগদীশচন্দ্র সখ্য। যাকে তিনি বলেছেন ‘বন্ধনহীন গ্রন্থি’। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ‘সাহিত্যিকের বিজ্ঞানী বন্ধুলাভ ও বিজ্ঞানীর সাহিত্যিক বন্ধুলাভ’-কে বলেছিলেন ওই যুগের ‘এক বিশেষ ঘটনা’। ‘জগদীশচন্দ্রকে বিজ্ঞানী হিসেবে সামাজিক প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাই ছিল প্রধান’ এই মন্তব্য করে বিকাশ লিখেছেন, ‘অনেকেই বলে থাকেন যে, জীবনের শেষ দিকে জগদীশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে মতবিরোধ হয় এবং দু’জনেই পরস্পরের থেকে একটু দূরে সরে আসেন।... জগদীশচন্দ্র বোধহয় প্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্যোগ, বিশেষ করে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পিছনে রবীন্দ্রনাথের অতখানি শক্তিক্ষয় ও আত্মনিয়োগ অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেছিলেন। মনে করেছিলেন, এতে রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রতিভার অপচয় ও ক্ষয় হতে পারে। এত সামান্য এই মতবিরোধ, অমন দুই প্রবল প্রতিভাধরের মধ্যে না থাকলেই বরং আমি বেশি অবাক হতুম।’‘সৃষ্টি ও কৃষ্টি’ পূর্বাপর একটানা রচনা নয়, বহু প্রবন্ধের সংকলন। প্রবন্ধগুলি দেশ এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত। আলোচ্যের নিরিখে সেগুলি বিজ্ঞান, সমাজ, সাহিত্য, দর্শন, শিক্ষা, স্মৃতিচর্চা এবং ব্যক্তিত্ব এই সাতটি বিষয়ের। রচনাগুলিকে ওই সব শিরোনামে বিন্যস্ত করে দুই মলাটের মধ্যে এনেছেন বিকাশ। দৈনিক বা সাময়িকপত্রের জন্য লেখা, তাই প্রায় সব ক’টিই স্বল্পদৈর্ঘ্যের। অথচ আলোচ্য বিষয় রীতিমত গুরুত্বপূর্ণ। এমন, যা নিয়ে দীর্ঘ বক্তব্য পেশ করা যায়। সিরিয়াস পাঠকের দিক থেকে তেমনটা আশা করাও অন্যায় নয়। কিন্তু বিকাশকে যাঁরা চেনেন, যাঁরা তাঁর কাজের সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা জানেন, বিস্তারিত ব্যাখ্যার পাণ্ডিত্যপ্রকাশে তাঁর অনীহা। তাঁর পছন্দ বরং বৈঠকি আড্ডা, কৌতুকী মন্তব্য, বুদ্ধিদীপ্ত ব্যঙ্গ এবং অবশ্যই সংবেদনশীল মনোভাব।
এই মনোভাবের দরুন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের মূল্যায়নে বিকাশ স্পষ্টবাক। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৫০ সালের ১১ জানুয়ারি বিজ্ঞান কলেজে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশেষ এক গবেষণাগার। উদ্দেশ্য সাইক্লোট্রন যন্ত্রের সাহায্যে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের খোঁজ-খবর নেওয়া। এর নেতৃত্বে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। তাঁর অনুরোধে গবেষণাগারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মাদাম কুরির কন্যা নোবেলজয়ী আইরিন জোলিয়ো কুরি। অধ্যাপক সাহার মতো এক জন পুরোপুরি জাতীয়তাবাদী বিজ্ঞানীর পক্ষে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনে এক জন বিদেশি বিজ্ঞানীকে ডেকে আনা কি কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক নয়? প্রশ্ন তুলে বিকাশের জবাব: ‘এমনকি হতে পারে যে, অধ্যাপক সাহা এই গবেষণাগার একদিন বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠুক, এই আশা করে এক জন বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানীর সাহায্যে এর উদ্বোধন করালেন, অথবা তাঁর বামপন্থী আন্দোলনের কর্মধারার সঙ্গে আইরিন জোলিয়ো কুরির পথের কোনও মিল খুঁজে পেয়েছিলেন?’ ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচার’ পত্রিকায় মেঘনাদের লেখা সম্পাদকীয় মন্তব্য: ‘বিশেষ ভাবে নির্বাচিত কিছু বৈজ্ঞানিকের হাতে যদি যথেষ্ট অর্থ ও ক্ষমতা দেওয়া হয়, তবে তাঁরা দেশ ও জাতিগঠনের সমস্যার যে সমাধান করে দেবেন, তা রাজনীতিবিদদের কাছে অকল্পনীয়।’ মনে হয় মেঘনাদের এই উপলব্ধি বিকাশেরও স্লোগান। এ কারণে ৩৫ বছর আগে কলকাতায় ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে আনন্দবাজার-এ প্রকাশিত প্রবন্ধে তাঁর ধিক্কার সেই সব প্রশ্নকর্তাদের, যাঁরা বলেছেন, ‘ভারতের মতো গরিব দেশে ৮ কোটি টাকা খরচ করে সাইক্লোট্রন, বলেন কী মশাই!’
সৃষ্টি ও কৃষ্টি-র অনেকখানি জুড়ে আছে বাঙালির সাম্প্রতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ জেহাদ। ‘দেওয়ালে ছবি টাঙানোরও তো একটা শেষ আছে’ প্রবন্ধে বিকাশের খেদ: ‘‘চলছে না, চলবে না’ আর্তনাদ থেকে কাতরধ্বনি বেরিয়ে আসছে। কী চলছে যে তা চলবে না? কোমর ভেঙে গেছে, মাথা গুলিয়ে গেছে শেষ পর্যন্ত।... যাঁরা ছিলেন দাদা, তাঁরা দিদির দলে ঢুকে পড়েছেন। পেট চালাতে হবে তো। কিন্তু মানসিকতার কোনওই পরিবর্তন আসেনি।’
পশ্চিমবঙ্গের দৈন্যদশা যে মেধা পরিচর্যার ক্ষেত্রে তলানিতে ঠেকেছে, সে কথা বিকাশ স্মরণ করেছেন বিশেষ প্রেক্ষিতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্রীয় সরকার ১০০ কোটি টাকা দিতে চায় এই খবরের সূত্রে তাঁর প্রবন্ধ ‘নিজের পিঠ নিজেই... অন্যেরা কী বলছে, শুনুন’। বরাদ্দ বাড়লেই যে মানসিকতা বদলায় না, তা জানিয়ে বিকাশ টেনে এনেছেন মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বেঙ্গালুরু মুম্বই পানে দৌড় প্রসঙ্গ। কী আছে ওখানকার গবেষণা প্রতিষ্ঠানে, যা এই কলকাতায় নেই? প্রশ্ন তুলে বিকাশের জবাব, ‘আমাদের বর্তমান মানসিকতাটা আমাদের বড় বোঝা। গবেষণার জগৎটা যে পাল্টে গেছে, প্রতিযোগিতা যে সেখানে তীব্রতর হয়েছে, কলকাতার গবেষককে এখন দৌড়তে হয় ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকের পাশাপাশি, এই সত্য বোধহয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালকেরা ভুলে গেছেন। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ানো নয়। প্রতিযোগীরা আমাদের পিঠ চাপড়ালে বুঝতে হবে আমরা দৌড়ে আছি।’
দৌড়ে আমরা নেই। অনেক দিন। কারণটা রাজনৈতিক না সামাজিক, তার ব্যাখ্যা দীর্ঘ হলে ভাল হত। তা না হোক, আত্মসমীক্ষা যে শুরু হয়েছে, সেটা ভাল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.