ঘরের মেয়ের ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখেও যা হয়নি, এ বার তা হল।
চোখের জল ফেলার আগে ক্ষোভের আগুনে জ্বলে উঠেছিল কামদুনি। সেই বিক্ষোভের আঁচ পৌঁছেছিল মহাকরণে, পরে মুখ্যমন্ত্রীর সফরেও। কিন্তু শুক্রবার কলকাতায় তাঁদের পাশে এত মানুষ দেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন কামদুনি থেকে আসা মহিলারা। কামদুনির বাসিন্দা সন্ধ্যা নস্কর শুধু বললেন, “এত লোক! সব কামদুনির জন্য?”
টিভিতে যাঁদের মুখ দেখা যায়, কেউ তাঁদের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, কামদুনির কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েই কলকাতার এই মিছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কচিকাঁচাদের কেউ ছুঁয়ে দেখছিলেন তাঁদের। চোখে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করছিলেন, “আপনারা কামদুনি থেকে এসেছেন?” এত সমবেদনা, এই সহমর্মিতা আশা করেননি কামদুনি থেকে আসা প্রায় ৬০ জনের ওই দলটি।
মিছিলে যোগ দেওয়ার ডাক পাওয়া ইস্তক কলকাতায় আসবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিল কামদুনি। এখানে আবার কোনও রাজনীতি থাকবে না তো! বৃহস্পতিবার বিকেলে গ্রামে ডাকা হয় সভা। সেখানেই ঠিক হয়, মিছিলে যেহেতু কোনও রাজনীতির পতাকা থাকছে না, তাই যাওয়া হবে মিছিলে। তবে মৃতার বাবা-মা-ভাইরা এবং টুম্পা, মৌসুমী কয়ালেরা যাবেন না। এত দিনের ধকলে শরীর ঠিক নেই কারও। মিছিলে যাবেন মৃতার অন্য আত্মীয় ও গ্রামের পুরুষেরা। আর যাবেন, তিন জন মহিলা। যাঁরা গ্রামে থাকবেন, তাঁদের পাহারা দেবেন অন্যরা। |
এর পরই থেকে ঘরে-ঘরে শুরু হয় তোড়জোড়। সকাল-সকাল উঠেই রান্না-বান্না চড়িয়ে দেন মহিলারা। ঘটনার পর থেকে টানা চোদ্দো দিনের মধ্যে প্রায় দিনই কাজে যেতে পারেননি এলাকার পুরুষেরা। ‘দিন আনি দিন খাই’ পরিবারগুলিতে এক দিন কাজে না গেলে বেশ ক্ষতি। তবু
এ দিনও কাজ বন্ধ করে দেন পুরুষেরা। এলাকার দোকান থেকে কেনা হয় কালো ফিতে। টুকরো-টুকরো করে কেটে তা দিয়ে তৈরি হয় কালো ব্যাজ।
কামদুনি থেকে কলেজ স্কোয়ার প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ। যাওয়া হবে কী করে? রাজনৈতিক দলগুলি গ্রাম থেকে লোক নিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
কিন্তু এখানে তো সে সব পাঠায়নি কেউ। তাই নিজেরাই চাঁদা তুলে ভাড়া করা হয় দু’টি ম্যাটাডর ভ্যান। কিন্তু দু’টি ম্যাটাডরে এত মানুষ ধরবে কী করে! এগিয়ে এলেন এলাকার মহিলারাই। তাঁরাই বেছে বেছে ৬০ জনকে তুলে দিলেন গাড়িতে। গাদাগাদি করে রওনা হল কামদুনি।
দিন চোদ্দো আগে ধর্ষিতা-নিহত মেয়েটির মৃতদেহ মর্গ থেকে নিয়ে এ ভাবেই ঠাসাঠাসি করে কলকাতায় রওনা হয়েছিলেন কামদুনির বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি ছিল, মৃতদেহ নিয়ে যাবেন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি। কিন্তু তাঁদের আটকে দিয়েছিল পুলিশ। পরে তাঁরা দেহ নিয়ে যান নিমতলা শ্মশানে।
এ বার আর পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয়নি কামদুনির বাসিন্দাদের। তবে খড়িবাড়ি রোড ধরে রাজারহাট-শিয়ালদহের ভিড় ঠেলে যেতে দেরি হয়ে যায় অনেকটাই। ততক্ষণে কলেজ স্কোয়ার থেকে বেরিয়ে গিয়েছে মিছিল। হিন্দ সিনেমার কাছে মিছিলকে ধরে ফেলল ম্যাটাডর।
গাড়ি থেকে নেমে মিছিলের মাথার দিকে ঢুকতে যেতেই এক প্রবীণ বকুনি দিয়েছিলেন। ‘‘এই এখানে ঢুকছেন কেন? পিছনে যান।’’ সেটা শুনেই রাস্তা ছেড়ে দাঁড়াতে বলল সাদা পোশাকের পুলিশ। আর ঠিক তখনই কে যেন বলে উঠল, “আরে, ওঁরাই তো কামদুনির সেই আন্দোলনকারীরা!” আচমকা থেমে গেল মিছিল। ‘‘কামদুনি! এসেছে, এসেছে!’’ সবাই এগিয়ে এলেন তাঁদের দিকে। সেই প্রবীণও এসে হাত ধরে মিছিলে ঢুকিয়ে নিলেন গ্রামবাসীদের। এক বৃদ্ধা ‘ষাট-ষাট’ বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কামদুনির শুভঙ্কর-অভিজিৎকে। কেউ চিনিয়ে দিলেন, ‘‘এরা ওই মেয়েটির খুড়তুতো ভাই।’’ মিছিলের কয়েক জন হাতে হাত ধরে একে বারে সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন সন্ধ্যা নস্কর, আশা ঘোষ ও কাজল নস্করকে। এঁরাই ছিলেন এ দিনের মিছিলে কামদুনির তিন মহিলা প্রতিনিধি।
তাঁদের পিঠে হাত রাখলেন
আরও এক মহিলা। তিনি সুটিয়ায় গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। নিচু স্বরে বললেন, “আপনাদের পাশে আমরাও আছি।”
|