মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ঘরে ফেরার লগ্ন আসন্ন হইতেই আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ লইয়া রুদ্ধশ্বাস তৎপরতা শুরু হইয়াছে। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ভার আফগান পুলিশের হস্তে অন্তরিত হইতে-না-হইতে কাতারের রাজধানী দোহায় তালিবানের অফিস খুলিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহিত বৈঠকে বসার ঘোষণা আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে বিষম ক্ষুব্ধ করিয়া তোলে। তাঁহাকে পাশ কাটাইয়া আমেরিকা ও তালিবান পাকিস্তানকে সঙ্গে লইয়া আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করিতে বসিয়া গিয়াছে, ইহা কারজাই মানিতে পারেন নাই। সম্ভাব্য যাবতীয় আপস প্রক্রিয়া হইতে তিনি আফগান সরকারকে গুটাইয়া লইতে উৎসুক। এখন পশ্চিমি বাহিনীর ঘাড়ে কারজাইয়ের মান ভাঙানোর বাড়তি দায় আসিয়া পড়িল। মার্কিন বিদেশ সচিব জন কেরির কাজ বাড়িল।
তালিবানকে বাদ দিয়া নয়, বরং তাহাকে সঙ্গে লইয়া বা শরিক করিয়াই আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ শাসক গোষ্ঠী গঠিত হইবে, ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের এই অবস্থান হামিদ কারজাইয়ের পক্ষে পরিপাক করা কঠিন। কিন্তু তালিবান তাহার বর্ধিত গুরুত্বের সুযোগ লইয়া নিজেদের প্রায় নির্বিকল্প আফগান শাসক রূপে তুলিয়া ধরিতে চায়। এ কাজে তাহাকে সাহায্য করিতেছে পাক সেনাবাহিনী। জেনারেল আসফাক পারভেজ কায়ানির সহিত জন কেরির উপর্যুপরি আলোচনাতেও এ ব্যাপারে ঐকমত্য রচিত হইয়া থাকিবে, যাহার অর্থ, হাক্কানি জেহাদি গোষ্ঠীকেও মর্যাদার আসন দেওয়া হইবে। সত্য, তালিবান নেতৃত্ব দুইটি মৌলিক প্রশ্নে মার্কিন শর্ত অন্তত মৌখিক ভাবে মানিয়াছে। এক, আল-কায়দার মতো কোনও জেহাদি গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিবে না; দুই, আফগানিস্তানের মাটিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের সূতিকাগার হিসাবে ব্যবহৃত হইতে দিবে না। ওয়াশিংটন এই আশ্বাসে খুশি। ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস’ বলিতে মার্কিনিরা আমেরিকা ও পাশ্চাত্য-বিরোধী সন্ত্রাসকেই বুঝে। তৃতীয় বিশ্বে, দক্ষিণ এশিয়ায়, ভারতীয় উপমহাদেশে যে সন্ত্রাসীরা ক্রমাগত অন্তর্ঘাতে নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষদের শয়ে-শয়ে নিধন করিয়া চলিয়াছে, যাত্রীবোঝাই ট্রেন, ভিন্নধর্মাবলম্বীর ধর্মস্থান, জনবহুল বাজার-হাট কিংবা গণতন্ত্রের পীঠস্থানরূপী সংসদভবন আক্রমণ করিতেছে, পশ্চিমি গণতন্ত্র তাহাকে অনায়াসে উপেক্ষা করিতে পারে। তাই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের গর্ভগৃহ হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানকে দীর্ঘ কাল ধরিয়া ‘সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ’-এর অছিলায় বিপুল সাহায্য দেওয়া হইয়াছে, যাহার বৃহদংশ পাক সেনাবাহিনী ও আই এস আইয়ের হাত ঘুরিয়া তালিবানকে অস্ত্র ও রসদ জোগাইতে ব্যয় হইয়াছে। প্রাক্তন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টন নিজেই এ কথা কবুল করিয়াছিলেন।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তালিবানকে কাবুল হইতে উৎখাত করিতে মার্কিন-নেটো সমরাভিযানের আবশ্যকতা তবে কী ছিল? আহত মার্কিন জাতীয়তাবাদকে তুষ্ট করা? প্রশ্নটি উঠিতেছে কারণ, হাক্কানি গোষ্ঠী কিংবা পাক তালিবান অথবা লস্কর-এ-তইবা, জামাত-উদ-দাওয়ার মতো জেহাদি জঙ্গি সংগঠন এ ভাবে মান্যতা পাইলে নয়াদিল্লির বিপদ সমূহ। ওই জেহাদি গোষ্ঠীগুলি বরাবরই কাশ্মীরকে ‘মুক্ত’ করিয়া দার-উল-ইসলামে রূপান্তরিত করিতে ব্যগ্র। আফগানিস্তানে উহাদের নিয়ামক ভূমিকা স্বীকৃত হইলে ভারতে সন্ত্রাসবাদী বিপদ বাড়িবে। এ কারণেই রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতীয় প্রতিনিধি আল-কায়দা, তালিবান ও লস্করের সন্ত্রাসবাদী জোটকে আফগানিস্তান হইতে উচ্ছেদের ডাক দিয়াছেন। আফগানিস্তানের পরিকাঠামো পুনর্নির্মাণের কাজে যে সকল ভারতীয় প্রযুক্তিবিদ ও কর্মীরা সে দেশের পথ-ঘাট, রেলপথ, হাসপাতাল, স্কুল গড়িয়া তুলিতেছেন, তাঁহারাও অপ্রাসঙ্গিক হইয়া পড়িবেন। আজ যদি দিল্লিকে বাহিরে রাখিয়া তালিবানের সহিত পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনও একতরফা বোঝাপড়ায় উপনীত হয়, ভারতের পক্ষে তাহা বিপজ্জনক হইবেই। তালিবানরা ইতিমধ্যেই ‘নির্বাসিত সরকার’-এর ন্যায় আচরণ করিতেছে, ‘আফগানিস্তানের ইসলামি আমিরশাহি’ নামকরণ পর্যন্ত করিয়া ফেলিয়াছে। ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী ‘লাল বিপদসীমা’ লঙ্ঘন না করার চেতাবনি দিতেছেন। কেহ শুনিবে কি? |