সিনেমা সমালোচনা...
ঋত্বিক একটি বোধের নাম
মলেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে এখনই ঠাটিয়ে চড় মারা উচিত। তিনি ভাল ডাক্তার, ‘চেতনা’ দলে ভাল অভিনয় করতেন, জানি। কিন্তু ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখতে দেখতে অ্যায়সা রাগ হল! ভদ্রলোক সিনেমা জানেন, সব বোঝেন। এত দিন ‘উড়ো চিঠি’র নখরা করছিলেন কেন?
ঋত্বিক-ভক্ত হিসেবে ছবি দেখতে গিয়েছিলাম ভয়ে ভয়ে। পত্রপত্রিকায় ফিসফিস, ঋত্বিক বোহেমিয়ান প্রতিভা। মদ খেয়ে, লিভার পচিয়ে অকালে মারা গেলেন। যে লোকটা বলে, ‘আমি কম্প্রোমাইজ করব না, তাই মদ খেয়ে জীবন শেষ করছি,’ মৃত্যুর সাড়ে তিন দশক পর তাকে ‘বোহেমিয়ান’ খোপে পুরে দেওয়া! এই আতুপুতু, ন্যাকাবোকা সমাজে ঋত্বিক নিয়ে ছবি?
শুরুতেই চমক। এই ছবি আদতে ঋত্বিক ঘটকের জীবনী নয়। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত চরিত্রটির নাম নীলকণ্ঠ বাগচী, অনন্যার নাম দুর্গা। ঋত্বিকের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ ছবিতে নায়ক-নায়িকার নাম ওই রকমই ছিল। নীলকণ্ঠের বেশির ভাগ ছবিই চলে না। তার একটি ছবিতে স্টেশনে বাগদি-বউ মারা যায়, অভিরাম বলে, আমার মা! দর্শকের শরীরে তখন কাঁটা দিয়ে যায় ‘সুবর্ণরেখা’র স্রোত। ছবির এক জায়গায় নীলকণ্ঠের ‘ঘরছাড়া’, ‘মেঘের আকাশে’, ‘সোনার নদী’ ইত্যাদি ছবির পোস্টার। প্রতিটি পোস্টারেই লেখা, নীলকণ্ঠ বাগচী প্রণীত। কে ভুলতে পারে, তাঁর ছবিতে এ ভাবেই ভেসে উঠত ‘ঋত্বিককুমার ঘটক প্রণীত।’ গল্প বলার একমাত্রিক রীতি ছুড়ে ফেলে ফ্যাক্ট এবং ফিকশনের এই মিশ্রণ বাংলা ছবি বহু দিন দেখেনি।
মিশ্রণই সব নয়। মাঝে মাঝেই সত্তর দশকের পটভূমিতে ঢুকে পড়ে একুশ শতকের সাম্প্রতিক। সাদা-কালো ছবির পুরোটাই মানসিক হাসপাতালে। সেখানে পুলিশ ঢুকে আসে। ‘নীলকণ্ঠ’ শাশ্বত চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘সব রাষ্ট্রই ভূত দেখে রে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার ভূত।’ হাসপাতালের মানসিক রোগীদের নিয়ে নাটক করেন নীলকণ্ঠ। পাগলা গারদের বাসিন্দা এক ধর্ষিতা আদিবাসী রমণী শেষে তাঁর চেষ্টাতেই নেচে ওঠে।
ঘটনা, গোবরা মানসিক হাসপাতালের দুই রোগী ঋত্বিক ঘটক এবং বিনয় মজুমদার একদা নাটক করেছিলেন। ধর্ষিতা আদিবাসী রমণী কমলেশ্বরের সংযোজন। তার নাচ ঋত্বিকের ব্যাকরণ মেনেই। মনে পড়ে, ‘অযান্ত্রিক’ ছবিতে কী ভাবে ঢুকে পড়েছিল ওরাওঁ নাচ? বাংলা ছবি ঝকঝকে হয়েছে, সবাই ভাতের বদলে পাস্তা খায়। কিন্তু মেধাবী ইন্টারটেক্সচুয়াল খেলা যে কত দিন বাদে ফিরে এল!
গোলটেবিলের দৃশ্যটি যেমন! কয়েক জন নীলকণ্ঠকে বলতে থাকে, ‘আপনি অ্যানার্কিস্ট।’ ‘বিপ্লব থেকে সরে গিয়েছেন।’ উত্তরে নীলকণ্ঠ: ‘দূর শালা! দর্শন পড়েছিস? শোষণ আর বঞ্চনাকে উপড়ে ফেলতে ভারতীয় দর্শন আর ইতিহাসও জানতে হবে।’ যুক্তি-তক্কো-গপ্পো ছবিতে নকশালপন্থীদের উদ্দেশে ঋত্বিকের একটা লম্বা সংলাপ ছিল ‘তোমাদের সিনসিয়ারিটি তোমাদের বীরত্ব এ সবে আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু তোমরা সম্পূর্ণ মিসগাইডেড! যত গাল দিই, এ দেশে সবচেয়ে উজ্জ্বল দার্শনিক চিন্তা জন্মগ্রহণ করেছে, কাজেই সবচেয়ে বড় ফিচেল বদমাইশদের হাতে এ দেশ প্রচুর হাতিয়ার তুলে দিয়েছে।’ কমলেশ্বর সেই সংলাপ ভেঙেচুরে নিয়ে এসেছেন সমসাময়িক প্রতর্কে। এখানেই মেধা, এখানেই জিত!
এই খেলার বিপদ একটাই। ঋত্বিকের সিনেমা, গল্প, ইন্টারভিউ, চিঠিগুলি না-জানা থাকলে রস পাওয়া দুষ্কর। ইন্টারভিউতে ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘সিনেমার প্রেমে আমি পড়ে নেই, মশাই। আমি গল্প লিখতাম। দেখলাম, গল্পের থেকে নাটকে আরও বেশি লোককে অ্যারাউজ করা যায়। তার পর দেখলাম, নাটকের থেকে সিনেমা আরও শক্তিশালী। যে দিন আরও শক্তিশালী মাধ্যম বেরোবে, সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাব।’ ১৯৭১ সালে স্ত্রীকে লেখা চিঠিতে এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সাধারণ সম্পাদক পি সি জোশীর কথা, “আমাকে বলেছে, ঋত্বিক, ইউ আর দ্য ওনলি পিপল্স আর্টিস্ট।” ছবিতে সযত্নে বুনে দেওয়া হয়েছে এই সব উক্তি। যাঁরা ঋত্বিক দেখেননি, কী ভাবে বুঝবেন এই অনুষঙ্গ? উত্তর একটাই। বুঝলে বুঝবেন, না বুঝলে বুঝবেন না। বোর্হেসের গল্প বা উমবের্তো একোর উপন্যাসেও অনেক ক্রস-রেফারেন্স থাকে, ধৈর্য নিয়ে পড়তে হয়।
এই ইন্টারটেক্সচুয়াল খেলাই ছবির দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াই ঘণ্টায় নিয়ে গিয়েছে। হাসপাতাল থেকে ‘নবান্ন’ নাটক, কখনও বা কমিউনিস্ট পার্টি। কখনও অ্যাডলার, ইয়ুং-এর মনোবীক্ষা, কখনও বা ঋত্বিকের ‘মাদার কমপ্লেক্স’। নদীতে ‘নাগরিক’ ছবির ঢঙে ভেসে যায় দুর্গাপ্রতিমা। চমৎকার! সবাই হুড়োতাড়া করে টি-২০ খেলবে কোন দুঃখে?
কমলেশ্বরের অন্যতম কৃতিত্ব, তিনি সত্যজিৎ বনাম ঋত্বিক ছেঁদো তর্কে ঢোকেননি। সত্যজিৎ প্রগতিতে বিশ্বাসী, তাঁর অপু রেললাইন আর টেলিগ্রাফের খুঁটিতে কান পেতে দূরের আওয়াজ শোনে। ঋত্বিক আদিম রূপকল্পে বিশ্বাসী, ‘কোমলগান্ধার’ ছবিতে ভিখিরি বালক সুপ্রিয়ার আঁচল টেনে ধরে। ঋত্বিক বুঝিয়ে দেন, ‘শকুন্তলা’র হরিণশিশু এই ভাবেই ফিরে আসে আজকের অনসূয়ার কাছে। দু’ জনের এত তফাত, তবু ’৭৬ সালে ঋত্বিকের স্মরণসভায় চমৎকার বলেছিলেন সত্যজিৎ, ‘আমাদের সকলের মধ্যে হলিউডের প্রভাব ঢুকে পড়েছিল, কিন্তু ঋত্বিক তা থেকে মুক্ত ছিল।’
এই ছবির অন্যতম উপকরণ, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়। তাঁর চেহারা মোটেই ঋত্বিকোচিত লম্বা, দোহারা নয়। তাতে কী? ‘হিচকক’ ছবিতে হিচককের সঙ্গে অ্যান্টনি হপকিন্সের চেহারার মিল-অমিলে কী আসে যায়? স্টুডিয়োতে ফিল্মের রিল মাথায় দিয়ে শুয়ে থাকার দৃশ্যে চমকে উঠতে হয়। ঋত্বিকের জীবনে এমনটাই ঘটেছিল। শাশ্বত যা করেছেন, হলিউড-ই এক এবং একমাত্র তুলনা।
মেঘে ঢাকা তারা
শাশ্বত, আবীর, অনন্যা, শুভাশিস
অনন্যা ভাল, বিজন ভট্টাচার্যের চরিত্রে শুভাশিস চমৎকার। মনীষা আদককে মঞ্চ-অভিনেত্রী জানতাম, আদিবাসী মেয়ের চরিত্রে পরিচালক তাঁকে চমৎকার ব্যবহার করেছেন।
রয়েছেন আর এক জন। পুরো সিনেমাটা শাশ্বতর সঙ্গে ধরে রাখেন তিনি। ‘ডাক্তার’ আবীর চট্টোপাধ্যায়। সহানুভূতিসম্পন্ন অবজার্ভার। নীলকণ্ঠের জীবনে তাঁর ভূমিকা নেই, কিন্তু মানুষটিকে বোঝার চেষ্টা করেন। কমলেশ্বর নিজে ডাক্তার বলেই কি তাঁর চিত্রনাট্যে এল এই চরিত্র?
সৌমিক হালদারের ক্যামেরা, রবিরঞ্জন মৈত্রের এডিটিং ছবিতে কথা বলেছে। শেষ দৃশ্য ক্রমে রঙিন, বঙ্গবালার হাত ধরে বাংলার নদী, সবুজ ধানখেত আর জলরঙের মতো পাহাড়ের দিকে পাড়ি দেন ঋত্বিক। এই টেকনিকালার দুনিয়ায় আজও বাংলার নদী, মাঠ, ঘেঁটুফুলে বেঁচে আছেন তিনি। বস্তুত, এই ছবি ফ্লপ করলে প্রযোজক এবং পরিচালক ঋত্বিকের মতোই উদ্ধত ভঙ্গিতে বলতে পারেন, ‘আমি ফ্লপ করিনি। দর্শক ফ্লপ করেছে।’ ঔদ্ধত্য ছাড়া ঋত্বিক হয়? ছবির শেষে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘এলিজি’ মোক্ষম, ‘তুমি গেছো। স্পর্ধা গেছে। বিনয় এসেছে।’
কত পাবে এই ছবি? দশে আট। দেবজ্যোতি মিশ্রের সঙ্গীত অসাধারণ, সলিল চৌধুরীকে ছুঁয়েও ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে’ বা ‘আহ্বান, শোনো আহ্বান’ যেন অন্য সুরে বেরিয়ে আসে। সঙ্গীত নিয়ে যাঁরা এত ভাবলেন, তাঁরা আর একটু এগোলেন না? ঋত্বিক মানে তো ‘যে রাতের মোর দুয়ারগুলি’র মতো রবীন্দ্রসঙ্গীতে আছড়ে পড়বে চাবুকের শব্দ। কিন্তু এ জন্য আধ নম্বরের বেশি কাটা যায় না।
আর আধ নম্বরের জন্য দায়ী শাশ্বত। তাঁর অভিনয় কেন হল না আরও নিখুঁত? তাঁর গালিগালাজে একটি লোকের উন্মাদনার মধ্যে তলিয়ে যাওয়া আছে। কিন্তু গনগনে, ক্ষিপ্ত রাগ নেই। গলার স্বর ফ্যাসফ্যাসে করলে পারতেন না? শেষ দিকে ঋত্বিকের গলায় টিউমার হয়েছিল।
নেই রামকিঙ্কর বেইজও। ঋত্বিকের তৈরি অসম্পূর্ণ তথ্যচিত্রে রামকিঙ্করের মুখের ক্লোজআপ প্রায় ভাস্কর্য। সেই রেফারেন্স এল না? মঞ্চের ঢঙে কেনই বা গণনাট্য পর্বে বারংবার উইংস থেকে উঁকি দেবেন ডাক্তার? কেনই বা থাকবে এত কথা? ঋত্বিক মানে অন্য আবহ। ট্রেনলাইন ধরে ছুটে যাবে ‘দোহাই আলি দোহাই আলি’ শব্দ। তার পরই লাইন থমকে যাবে। সামনে আদিগন্ত পদ্মা। কিন্তু কমলেশ্বর এই কথাভার দুর্বলতা অক্লেশে সামলে নিতে পারবেন। সেই প্রতিভা তাঁর আছে। আধ নম্বরের বেশি কাটা অনুচিত।
বাকিটা ব্যক্তিগত পছন্দ। ‘সুবর্ণরেখা’র মৃত্যুদৃশ্য আছে। নেই হরপ্রসাদ আর ঈশ্বরের ভেঁপু বাজিয়ে রেসকোর্সে যাওয়া। ফেলিনির ‘লা দোলচে ভিতা’র সমকক্ষ এক কার্নিভাল-দৃশ্য। এখানেও আধ। সব মিলিয়ে দুই নম্বরের বেশি কাটতে পারলাম না।

পুনশ্চ: থাপ্পড়টা? ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’য় শাঁওলি তখন বঙ্গবালা। শ্যুটিংয়ে কাঁদতে পারছেন না, আচমকা ঋত্বিকের চড়। তার পরই ‘কেন চেয়ে আছ গো মা’-র ঐতিহাসিক দৃশ্য। কমলেশ্বর ফিল্ম রিভিউয়ারের মধ্যে আবেগ উস্কে দিয়েছেন, থাপ্পড় তো খেতেই হবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.