রাস্তায় কাঁটাগাছ বিছিয়ে গাড়ি আটকে মুখে রুমাল বাঁধা দশ বারো জন দুষ্কৃতী খুব কাছে থেকে গুলি করে খুন করল মালদহের হবিবপুর পঞ্চায়েত সমিতির বিজেপি প্রার্থী নৃপেন মণ্ডলকে (৩৯)। রবিবার রাতের এই ঘটনার পরে এক ব্লক সভাপতি-সহ পাঁচ তৃণমূল কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে বিজেপি। তৃণমূল অবশ্য দাবি করেছে, এই ঘটনায় তাঁরা জড়িত নন।
|
নৃপেন মণ্ডল। |
রাত তখন দশটা। জিয়াকন্দরে প্রচার সেরে নিজের বাড়ি জয়দেবপুরে ফিরছিলেন নৃপেনবাবু। একটি ছোট গাড়িতে তিনি বসেছিলেন চালকের পাশের আসনে। পিছনে ছিলেন তাঁরই দলের আরও তিন জন। জয়দেবপুর থেকে আড়াই কিলোমিটার আগে হরিপুরে মোরামের রাস্তার উপরে ফাঁকা জায়গায় বাবলা গাছের কাঁটা বিছোনো ছিল। তাই দেখেই চালক নির্মল প্রসাদ গাড়ি থামিয়ে দেন। নৃরেনবাবুর সঙ্গী বাবলু মণ্ডল বলেন, “আমরা তখনও বুঝতেই পারিনি এটা একটা ফাঁদ। কাঁটা সরানোর জন্য নির্মল নামতে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই আশপাশের ঝোপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে মুখ বাঁধা বেশ কয়েকজন যুবক। তারা এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে থাকে।” প্রায় দশটি গুলি লাগে নৃপেনবাবুর গায়ে। গুরুতর আহত হয়েছেন নির্মলবাবুও। মালদহ মেডিক্যাল কলেজে চিকিত্সাধীন নির্মলবাবু বলেন, “জানলা খোলা ছিল। খুব সহজেই ওরা নৃপেনদাকে খুন করে চলে গেল।” সকলেরই পরনে ছিল হাফপ্যান্ট, গেঞ্জি। নৃপেনবাবুর গায়ে লেগেছে চারটি গুলি। নির্মলবাবু বলেন, “ওদের কারও হাতে ছিল লম্বা আগ্নেয়াস্ত্র, কারও হাতে পিস্তল।” ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন রক্তাক্ত নৃপেনবাবু।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পালিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা।
সোমবার শিলিগুড়িতে তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “যে কোনও মৃত্যুই দুঃখজনক। তবে এই খুনোখুনি হানাহানি করে অস্থিরতা তৈরির চক্রান্ত চলছে।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের নারী ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র বলেন, “বিজেপি-র অন্তর্কলহের জেরেই নৃপেনবাবু খুন হয়েছেন।” নৃপেনবাবুর নেতৃত্বে বিজেপি টানা ১৫ বছর ধরে জাজইল গ্রাম পঞ্চায়েত দখলে রেখেছে। দোষীদের গ্রেফতারের দাবিতে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত নৃপেনবাবুর দেহ আটকে বিজেপি-র কর্মী সমর্থকরা এই দিন বিক্ষোভ দেখান। জেলা এসপি কল্যাণ মুখোপাধ্যায় বলেন, “তল্লাশি শুরু হয়েছে।”
বিজেপির জেলা সভাপতি শিবেন্দু শেখর রায় সরাসরিই অভিযোগ করেছেন, “বিজেপি প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করার জন্য তৃণমূল হুমকি দিচ্ছিল। হবিবপুরের তৃণমূল ব্লক সভাপতি উজ্জ্বল মিশ্র এই হুমকি ও সন্ত্রাসের নেতৃত্ব দেন। তাঁর নির্দেশেই তৃণমূলের গুন্ডারা আমাদের প্রার্থীকে খুন করেছে।” সাবিত্রীদেবীর অবশ্য দাবি, “মিথ্যে অভিযোগ।” উজ্জ্বলবাবুর কথায়, “এলাকার আসনগুলিতে পরাজয় নিশ্চিত জেনেই বিজেপি এই মিথ্যে অভিযোগ করছে।”
এই ঘটনায় বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব নির্বাচন কমিশনকে একটি চিঠিতে লিখেছে, মনোনয়ন পর্বে রাজ্য জুড়ে তৃণমূলের যে সন্ত্রাস চলেছে, তারই বলি হয়েছেন নৃপেনবাবু। কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী না পেয়েও কমিশন মনোনয়ন চালু করে দিয়েছে বলেই এত মানুষ হিংসার শিকার হয়েছেন। এই প্রেক্ষিতে বিজেপি-র দাবি, যাঁরা মনোনয়ন দিতে পারেননি, আধা সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতে তাঁদের জন্য নতুন করে মনোনয়ন জমা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। আর ভোট হোক সাত দফায়। এই দিন কলকাতায় কেষ্টপুরের কাছে ভিআইপি রোড অবরোধ করে বিজেপি।
এই দিন পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারের জন্য রাখা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাট আউট পুড়িয়ে দেওয়া নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে কোচবিহার শহর লাগোয়া টাকাগছেও। সোমবার ওই ঘটনার প্রতিবাদে কোতোয়ালি থানায় বিক্ষোভ দেখিয়েছেন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। এদিন তৃণমূলের বিরুদ্ধে পাল্টা সন্ত্রাসের অভিযোগে জেলাশাসকের দফতরে স্মারকলিপি দেয় কংগ্রেস। একই অভিযোগে এসইউসিও পুলিশ সুপারের দফতরের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ করে।
সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহানন্দ সাহা বলেন “তৃণমূল নিজেরাই এলাকায় উত্তেজনা ছড়াতে কাট আউট পুড়িয়ে দেয়।” ফরওয়ার্ড ব্লকের কোচবিহার জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহ বলেন, “তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দলে ওই ঘটনা হয়েছে কিনা সেটাও দেখা দরকার।” একই দাবি করেছেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি শ্যামল চৌধুরীও। |