আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সমাজ আগেই সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে দিয়েছে। এ দিন ব্রিটেনের নামী দুই জুয়াড়ি সংস্থাও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির বাজির দরে ভারতকে পরিষ্কার ফেভারিট ঘোষণা করে দিল! জুয়ার নিয়মই হল, যা ঘটার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, তার ওপর খেললে সবচেয়ে কম টাকা পাওয়া যায়। সেই মতো ল্যাডব্রোকসে ধোনির ট্রফি হাতে তোলার ওপর কেউ খেললে সে ৮ পাউন্ড খরচায় জিতবে মাত্র ১৫ পাউন্ড। অর্থাৎ রোববার এজবাস্টনে টিম ইন্ডিয়া জিতলে সে দ্বিগুণেরও কম টাকা পাবে। প্রায় ৭০০ টাকা খেলে পাবে ১৩০০ টাকার মতোন। ইংল্যান্ডের ওপর খেললে সেখানে দ্বিগুণের অনেক বেশি। আর দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর খেলে তো প্রায় তিনগুণ পাওয়া সম্ভব যদি তারা ট্রফি তোলে। উইলিয়ামস হিল এখানকার আরও একটা প্রসিদ্ধ বেটিং সংস্থা। তারাও ভারতকে অবিসংবাদী সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে দিয়েছে।
জুয়ার বাজারে খেলে কে কী টাকা জিতল তাতে অবশ্য ধোনিদের ব্যক্তিগত ভাবে আসে যায় না। আইসিসি-র বিদায়ী এই টুর্নামেন্ট থেকে তাঁদের প্রাপ্তি হল, হৃত মর্যাদার পুরনো অ্যাকাউন্টটা এনপিএ মুক্ত হয়ে ক্রেডিট ব্যালেন্স আসা। রোববার স্কাই টিভিতে পাশাপাশি বসে গাওয়ার-বোথাম-নাসির-আথারটনরা যা প্রশংসা করছিলেন নতুন মুখে ভরা ভারতীয় দলের, তা অসামান্য। আজ নিজের কলমে ডেরেক প্রিঙ্গল লিখেছেন, ‘সেমিফাইনাল লাইন-আপ কী হবে জানি না। তবে ভারতের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডকে যাতে পড়তে না হয় সেই আশাই করছি।’
রোববার তো খেলা। ট্র্যাভেল। কিছুই ছিল না। বার্মিংহ্যামের হোটেলেই নিশ্চয়ই ম্যাচ দেখছিলেন ধোনিরা। যদি স্কাই স্পোর্টস শো-টা দেখে থাকেন আর আজ প্রিঙ্গলের লেখাটা পড়েন, মনে মনে নিশ্চয়ই ভাবছেন সত্য সেলুকাস। কী বিচিত্র এই দ্বীপভূমি! দু’বছর আগে এই লোকগুলোই তো ০-৪-এর পর আমাদের কী কী না বলেছিল! |
ওভালে এ দিন শ্রীলঙ্কা-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ দেখতে এসে অবাক অভিজ্ঞতা। মনে করা হচ্ছিল মুরলীধরনের অবসরের পর এখানকার মাঠে নামা শ্রীলঙ্কা তেমন সমর্থন পাবে না। আগের ম্যাচেই তো তাদের বিরুদ্ধে তীব্র ব্যারাকিং হয়েছে তামিলদের বিরুদ্ধে মানবশোষণ ও অত্যাচারের প্রতিবাদে শ্রীলঙ্কা টিমকে বয়কট করা হোক। কেউ যেন তাদের খেলা দেখতে না যায়। অথচ ওভাল মাঠ উপচে শ্রীলঙ্কানরা! শ্রীলঙ্কান তামিলে যদি লন্ডন ভর্তিও থাকে, তাঁরা নিশ্চয়ই ক্রিকেটমাঠকে রাজনীতির পীঠস্থান বলে মনে করেননি। নইলে স্যা-চি-ন, স্যা-চি-নের মতোই গোটা মাঠ শ্রী-ল-ঙ্কা, শ্রী-ল-ঙ্কা এ ভাবে গর্জে উঠত না। তার চেয়েও আশ্চর্যের, ওভালে যাঁর সঙ্গেই দেখা হচ্ছে তিনি বলছেন ইন্ডিয়াকে রোখা যাবে না। রোববার রাতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ির কাছে নর্থহোল্ট এলাকার জনপ্রিয় ‘ভেনু ফাইভ’ রেস্তোরাঁয় দেখলাম স্ক্রিনে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি দেখতে দেখতে লোকে কার্যত নাচছে, গাইছে আর বলছে ইন্ডিয়া। এ বার ইন্ডিয়া। এরা না হয় অন্ধ ভারত সমর্থক। অনেকেই এসেছেন শিখ অধ্যুষিত কাছাকাছি এলাকা সাউথহল থেকে। ওভালে যাঁরা ভারতকে ফেভারিটের তকমা দিচ্ছেন তাঁরা তো ব্রিটিশ ক্রিকেট কর্তা, আইসিসি-র লোক, নয়তো অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া।
কারও যেন মনেই পড়ছে না এটা চূড়ান্ত অনিশ্চিত ওয়ান ডে ক্রিকেট। ওয়ান ডে সিরিজ নয়। থ্রি-ম্যাচ সেমিফাইনাল বা ফাইনাল নয়। গোটা টুর্নামেন্টে এক দিন ‘ল অব অ্যাভারেজ’ বলে একটা ব্যাপার হাজির হয়ে যেতেই পারে। এক দিন টিমটা দাঁড়িয়ে যেতেই পারে। সৌরভ যেমন অস্ফুটে বলছিলেন, “আমরা দারুণ খেলতে খেলতে সে বার (সাল ২০০০) ফাইনালে দুম করে হেরে গেলাম।” ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ম্যাচ উইনার অনিল কুম্বলে সে দিনই ফাইনালে বাজে বল করেছিলেন। তেরো বছর পর যা আবার ঘটতেই পারে। কিন্তু এই যে লিখলাম, কেউ মাথাতেই আনতে চাইছে না। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে প্রয়াত ববি মুরের ব্রোঞ্জ মূর্তির তলায় একটা ছোট তোড়া এ দিন। যা অভাবিত কারণ মুরের জন্ম ১২ এপ্রিল। মৃত্যু ২৪ ফেব্রুয়ারি। মারা যাওয়ারও কুড়ি বছর পূর্তি হয়নি। তা হলে?
মনে হল সব তা হলে-র ব্যাখ্যা নেই। কারণ মূর্তির পাদদেশে কিছু ভারত সমর্থকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে যাঁরা “বার্মিংহ্যামে টিম ইন্ডিয়ার জয়ের সাক্ষী থাকতে ছুটছেন।” কে বোঝাবে যে ভারত আগে কার্ডিফের গাঁট পেরোক। তার পর তো ফাইনাল!
আর বিলেতে তার ক্রিকেটারদের ঘিরে যখন জমজমাট ইজ্জতের এই আবহ, তখন ক্রিকেট সমাজের একটা অংশ তীব্র ব্যঙ্গ করছে তার ক্রিকেট কর্তাদের। ফাইনালের দিনই লর্ডসে আইসিসি-র চিফ এগজিকিউটিভ বৈঠক। তার দু’দিন পর, মঙ্গলবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভা আইসিসি-র বার্ষিক বৈঠক। ডিআরএস পদ্ধতি গ্রহণ সহ অনেক জরুরি ব্যাপার ঠিক হবে সেখানে। ধোনি এখনই জানেন, কার্ডিফে বিষ্যুদবার পাওয়ার-প্লেতে কাকে দিয়ে বল করাবেন? ভারতীয় ক্রিকেট কর্তারা কিন্তু জানেন না মঙ্গলবারের বৈঠকে তাঁদের হয়ে কে প্রতিনিধিত্ব করবেন?
কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্ট না আসলি প্রেসিডেন্ট? ডালমিয়া? না শ্রীনি? নিয়ম অনুযায়ী কে যাবেন সেটা মনোনয়ন করার কথা কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্টের। কিন্তু সেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা মোটেও ডালমিয়ার নেই। যাঁর পছন্দের সিলমোহরে তিনি শেষমেশ প্রেসিডেন্ট হলেন, সেই নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন তিনি যে আসলে বৈঠকে যেতে চাইছেন। শোনা যাচ্ছে শ্রীনিবাসন ফোনে ডালমিয়াকে অনুরোধ করেছেন, এইটায় আমার নাম পাঠিয়ে দাও। স্পট-ফিক্সিং বিদীর্ণ সময়ে তিনি যে এমন অনুরোধ করতে পারেন, কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। ডালমিয়া ঘনিষ্ঠমহলে বলেছেন, তিনি নিজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ব্যাপারটাকে এই পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান না যেখানে মনে হতে পারে, প্রাক্তন আইসিসি প্রধান তিনি একটা আইসিসি বৈঠকে যাওয়ার জন্য ছোঁকছোঁক করছেন। |
ভারতীয় বোর্ডের গরিষ্ঠ অংশ মনে করে ডালমিয়ার কড়া হওয়া উচিত। এই সময় শ্রীনিকে পাঠালে বিশ্ববাজারে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। দেশেও ভুল সঙ্কেত পৌঁছবে। শ্রীনি আবার জেদ ধরেছেন যে, আইসিসি-তে না গেলে তাঁর সম্পর্কে বিশ্বক্রিকেটের ধারণা হবে তিনি সম্পূর্ণ ক্ষমতা হারিয়েছেন। উপয়ান্তর না দেখে ডালমিয়া এই মামলা পাঠিয়ে দিয়েছেন অরুণ জেটলির কাছে। জেটলিই বকলমে এখন ভারতীয় ক্রিকেটের ‘কিং মেকার’। তিনি যদি বুঝিয়ে শ্রীনিকে নিরস্ত করতে পারেন এ যাত্রা। সিদ্ধান্ত অবশ্য নিতে হবে আগামী এক দিনের মধ্যেই। কারণ আর হাতে সময় নেই।
অন্য দেশের ক্রিকেট কর্তারা খুব আগ্রহের সঙ্গে ভারতীয় বোর্ডের এই মনোনয়নের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ওঁরা কেউ চান না শ্রীনি আসুন। এঁদের মতে ডালমিয়া-বিন্দ্রারা যেটা করে গিয়েছেন, সেটা ক্রিকেট কূটনীতি। শ্রীনি যেটা করে সেটা হল ভারতীয় ক্ষমতার জোরে দাদাগিরি। আলাপ আলোচনার কোনও ধারই ধারেন না। তাঁর ভাবখানা থাকে, ভারত যা বলবে সেটাই প্রথম ও শেষ কথা। যদি তোমরা না শোনো এখুনি আইসিসি থেকে বেরিয়ে যাব।
ভারতীয় বোর্ডের অভ্যন্তরেও আইসিসি বৈঠকের প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়ে তুমুল আলোড়ন আর কৌতুহল। আইএস বিন্দ্রা এ নিয়ে তাঁর সর্বশেষ ব্লগ লিখছেন। যা বার হবে মঙ্গলবার। ললিত মোদী এ দিনও লন্ডনের বাড়ি থেকে ফোনে বললেন, “আমার মতে ডালমিয়া বা শ্রীনি কারও এই বৈঠকে আসা উচিত নয়। কিন্তু আমি যা বলে আসছিলাম, সেটা কত সত্যি এ বার নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে যে বোর্ডে শ্রীনির ক্ষমতা মোটেও চলে যায়নি। শ্রীনিকে কেউ সাহস করে এটুকু বলতে পারছে না যে, ভাবছ কী করে আইসিসি মিটিংয়ে যাবে। তুমি অতীত কাল হয়ে থাকো।”
ভারতীয় বোর্ডের অনেক সদস্যই মনে করেন, শ্রীনিকে আটকাতে হবে এবং হয়তো শেষ পর্যন্ত যাবে। পাশাপাশি এটাও গভীর উদ্বেগের কারণ যে, তার মানে তো সত্যিই লোকটার প্রতিপ্রত্তি এখনও ভারতীয় ক্রিকেটে যথেষ্ট আছে। তা হলে আর শ্রীনি যুগ শেষ হল কোথায়?
ধোনির টিমে নির্দিষ্ট কোনও ম্যাচ উইনার নেই। একাধিক প্লেয়ার ম্যাচ জেতাতে পারে। কিন্তু ভগ্ন ভারতীয় বোর্ডে ম্যাচ উইনার এখন এক জনই। আর শ্রীনির বিরুদ্ধে বোর্ডের গরিষ্ঠ অংশ ম্যাচ জেতার জন্য জেটলির উইনিং স্ট্রোকের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। অন্তহীন কৌতুহল ২৫ জুন লর্ডসে কোন ভারতীয় ক্রিকেট কর্তা ঢুকবেন?
২৫ জুন আবার তিরিশ বছর পূর্তি হচ্ছে তিরাশির বিশ্বকাপ জয়ের। ভারতীয় ক্রিকেটে অসীম গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন। কিন্তু এই মুহূর্তে ও সব ভাবছে কে? কাপ হাতে কপিল নয়, কর্তারা নিজেদের নিয়ে মত্ত! |