বছর তিনেকের ফুটফুটে মেয়েটা প্রায়ই মা-কে বলত, “ড্যাডা মেড বোবো অন মাই জিজি!” ব্যথা দেওয়া বা আঘাত করাকে একরত্তি মেয়ে তার আধো বুলিতে ‘বোবো’ বলত, আর ‘জিজি’ বলে বোঝাত নিজের গোপনাঙ্গকে। মা জানতেন মেয়ের সেই নিজস্ব ভাষা। উচ্চবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত, রুচিশীল পরিবারে আদরের সন্তানের মুখে সেই কথা শুনে মায়ের চৈতন্যে ধাক্কাও লাগত, কিন্তু বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করত না। মেয়ের শরীরে কালশিটে দেখেও ভেবে নিতে ভালবাসতেন, ‘নিশ্চয়ই খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে লেগেছে।’
আসলে এত কদর্য বাস্তবের সামনে দাঁড়ানোর হিম্মত পেতেন না বলেই মা নিজেকে বোঝাতেন, এ সব বাচ্চার খেয়ালি প্রলাপ, কল্পনা। নিজের মনে বলতেন, ‘সব ঠিক আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ ঠিক হয়নি অবশ্য। হুঁশ যখন ফিরল তত দিনে বাবার দ্বারা প্রায় প্রতি দিন অত্যাচারিত হতে হতে শরীরে-মনে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত তিন বছরের কন্যা।
বেঙ্গালুরুর ঘটনা। শিশুকন্যার মা আদতে কেরলের। বড় হওয়া, পড়াশোনা সব কলকাতায়। স্বামী ফরাসি। বেঙ্গালুরুতে ফরাসি বিদেশ মন্ত্রকের উচ্চপদস্থ অফিসার। বেঙ্গালুরুর অভিজাত এলাকায় স্ত্রী, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে জমিয়ে সংসার। সব এলোমেলো হয়ে গেল। থানায় স্বামীর বিরুদ্ধে মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করলেন ভদ্রমহিলা। অভিযুক্ত গ্রেফতার হলেন ২০১২ সালের জুন মাসে। কিন্তু অক্টোবরে জামিন পেয়ে গেলেন।
ছেলেমেয়েকে নিয়ে আপাতত নিজের মা-বাবার কাছে রয়েছেন মহিলা। প্রতি মুহূর্তে তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করছে একটাই অনুশোচনা: কেন প্রথমেই গুরুত্ব দিলেন না মেয়ের কথার? কেন মেয়ের দেহে সন্দেহজনক আঘাতের চিহ্ন দেখেও গা করলেন না? কোথাও কিছু একটা গোলমাল হওয়ার ইঙ্গিত পেয়েও কেন তা স্বীকার করতে চাইলেন না? উলটে ভাবতে চাইলেন, তাঁর সন্তানবৎসল, যত্নবান স্বামী এটা কিছুতেই করতে পারেন না। |
এই ‘আমার বাড়িতে, আমার পাড়ায়, আমার বাচ্চার এটা হতে পারে না, আমার পরিচিত কেউ এতটা পাষণ্ড হতে পারেন না’— ভাবনাটাই খেয়ে ফেলছে অনেক শিশুর শৈশব। দিল্লির নির্ভয়া-কাণ্ড কিংবা বারাসতের কামদুনি-র মতো কোনও কোনও ঘটনা প্রচারের আলোয় এসে পড়লে তা নিয়ে খানিক চেঁচামেচি, দোষারোপ, মোমবাতি মিছিল হয়, কিন্তু অসংখ্য পরিবারে বা পরিচিত পারিপার্শ্বিকে প্রায় প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যেতে থাকা শৈশবের কথা অপ্রকাশ্যই থেকে যায়। বস্তুত, শিশুর উপর অধিকাংশ যৌন হেনস্থার ঘটনা পরিবারের মধ্যেই চেপে দেওয়া হয়। বেঙ্গালুরুর ধর্ষিতা শিশুর মা আত্মীয়স্বজন বন্ধু সাংবাদিক প্রত্যেককে এখন একটাই কথা বলছেন, ‘ছোট ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে এমন জঘন্য কিছু কোনও দিন হতে পারে না’ এই ধারণা থেকে আগে বার হতে হবে। এ ধারণা আমাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
বাড়াবাড়ি করছি? বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সাধারণ প্রবণতা বলে দেখাচ্ছি? একটা ছোট্ট হিসেব দিই। বছর পাঁচেক আগে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল ভারত সরকারের মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ১৩ হাজার শিশুর সাক্ষাৎকার নিয়ে দেখা গিয়েছিল, এদের মধ্যে ২১ শতাংশ শিশু কোনও না কোনও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। বাড়ির বা পাড়ার কাকা, জেঠা, দাদু, মামা স্থানীয়ের হাতে নির্যাতিত শিশুর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তার পরেই রয়েছে পরিবারের কোনও তুতো দাদার হাতে যৌন হেনস্থার ঘটনা। এর মধ্যে ধর্ষণ থেকে শুরু করে পায়ুসঙ্গম, যৌনাঙ্গে হাত, নগ্ন করে ছবি তোলা, সব কিছু রয়েছে। দুই থেকে দশ বছর বয়সিদের অত্যাচারিত হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। এবং ছোট মেয়েদের থেকে অনেক বেশি সংখ্যায় যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছে বাচ্চা ছেলেরা। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’র সমীক্ষা বলছে, ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ভারতে শিশু-ধর্ষণের মোট ৪৮৩৩৮টি কেস নথিভুক্ত হয়েছে। ধরে নেওয়া যায়, আরও কয়েক হাজার কেস অগোচরে থেকে গিয়েছে।
কলকাতার এক পরিচিত অ্যানাটমির ডাক্তারবাবু এক সরকারি মর্গের দায়িত্বে আছেন। ময়না তদন্তের পাশাপাশি ধর্ষণের অভিযোগে শারীরিক পরীক্ষাও তাঁকে করতে হয়। তীব্র হতাশা নিয়ে বলছিলেন, ‘দিন কয়েক আগে একটা তিন বছরের বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে আসা হল। বাচ্চাটা দৃষ্টিহীন, রেপ ভিকটিম। পরীক্ষার জন্য ঘরের আলো নেভাতেই বাচ্চাটি আর্তনাদ করে উঠল। এতটাই ট্রমাটাইজ্ড হয়ে আছে সে। পরীক্ষার জন্য জামাকাপড় খুলে শিউরে উঠলাম। এমন ভাবে অত্যাচার করে রক্তারক্তি করা হয়েছে ভাবা যায় না।’ জানা গেল, তাঁর কাছে প্রতি মাসে দশ জন ধর্ষিতা পরীক্ষা করতে এলে তার মধ্যে দু’জন শিশু।
শিশুরাই বিকৃতকাম মানুষের ‘সফট টার্গেট’। শিশুকে সহজে ভুলিয়ে কব্জা করা যায়, একটা লজেন্সের টোপ দিলেই কাজ হয়। অধিকাংশ সময় বাচ্চাটি বুঝতেই পারে না তার সঙ্গে কী হল। ফলে কাউকে ভাল করে বোঝাতে বা জানাতে পারে না। আবার বুঝতে পারলেও তার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের ক্ষমতা থাকে না। খুব সহজে এদের দাবড়ে, ভয় দেখিয়ে, শক্তি প্রয়োগ করে বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়া যায়। তা ছাড়া, এই উপমহাদেশে শিশু-ধর্ষণ নিয়ে ঢাকঢাক-গুড়গুড়-এর ঐতিহ্য অনন্তকালের। ‘বাচ্চা ঠিক সব কিছু ভুলে যাবে। বরং এই নিয়ে হইচই করলে শুধু শুধু তার ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে, পরিবারের সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে।’— এই মানসিকতা নিয়েই চলছি আমরা।
আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবকদেরই এবং কিছু অংশে স্কুলকে। শুধু টিনএজার বা যুবতীদেরই ধর্ষিতা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, এই ধারণা থেকে প্রথমে বেরিয়ে আসতে হবে। শিশু কন্যা বা পুত্রের উপর একই ভাবে যৌন অত্যাচারের আশঙ্কা থাকতে পারে এটা না বুঝলে সতর্ক হওয়ায় সম্ভব নয়। দায়িত্ব নিতে হবে স্কুলকেও। প্রতিটি স্কুলে যেমন লাইব্রেরি ক্লাস, গান বা পিটি-ক্লাস হয় তেমনই অন্তত সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত একটা ক্লাস কি রাখা যেতে পারে না যেখানে শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রী পরস্পরের সঙ্গে শুধু গল্প করবেন? এই গল্পের সুযোগে সারা সপ্তাহে কোন ছাত্রছাত্রীর কোন ব্যাপারটা ভাল লাগল, কোনটা খারাপ লাগল, কে তার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করল সব কিছু জানা যেতে পারে। খোলাখুলি আলাপে কোনও সমস্যা টের পেলে শিক্ষকশিক্ষিকারাই বাড়িতে জানাবেন।
কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে বাড়িতেও। যেমন, শিশুকে নগ্ন করে না-রাখা, পরিস্থিতিবিশেষে আত্মীয় বা প্রতিবেশীর কাছে দীর্ঘক্ষণের জন্য না-পাঠানো, পাঠালেও মাঝে কয়েক বার তার খোঁজ নেওয়া। একটু জ্ঞান হওয়ার পর সহবৎ শেখানোর মতোই শিশুকে শেখাতে হবে, সবার সামনে জামা খুলতে নেই, শেখাতে হবে, কেউ জোর করে কোলে বসাতে চাইলে, জবরদস্তি চুমু খেলে, যৌনাঙ্গে বা স্তনে হাত দিলে মাকে বা ভরসার কাউকে এসে বলতে হয়। শেখাতে হবে, পরিচিত-অপরিচিত কেউ লজেন্স, পুতুল বা বিস্কুট দেবে বলে নিজের ঘরে ডাকলে সেখানে যেতে নেই।
অনেকে প্রতিবাদ করতে পারেন, এ ভাবে তো শিশুর নির্ভেজাল, অমলিন শৈশব খুন করে তাকে অকালপক্ব করে দেওয়া হবে। দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে পৃথিবীর কুৎসিত মুখটার মুখোমুখি। শিশুর মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে প্রাপ্তবয়স্ক সংশয়, সন্দেহ। হয়তো কিছুটা হবে। কিন্তু পালটা যুক্তিও বড় কম নয়: যদি সতর্ক না হওয়ার ফলে কোনও শিশু ধর্ষিত হয় তা হলে তার শৈশব তো অনেক বেশি তছনছ হবে। তার থেকে অল্প বয়সে তাকে মানসিক ভাবে সজাগ, সচেতন করলে যদি তাকে যৌন হেনস্থা থেকে বাঁচানো যায় সেটাই শ্রেয় নয় কি?
বাচ্চার কথাকে গুরুত্ব দেওয়াও শিখতে হবে অভিভাবককে। তার সব কথা ‘ফালতু’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার ফল মারাত্মক হতে পারে। প্রতি দিন বাড়িতে, স্কুলে, পাড়ায় শিশু কার কার সঙ্গে কী কী করল তা খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করতে হবে। নিয়মিত তার শরীর, বিশেষত যৌনাঙ্গ, প্যান্টি ভাল করে পরীক্ষা করা দরকার। কোনও অস্বাভাবিক ক্ষত বা দাগ দেখলে সেটা কী করে হল শিশুর থেকে জানতে হবে।
যে সব বাচ্চা স্কুলবাসে বা পুলকারে যাতায়াত করে তাদের বাবা-মাকে অতিরিক্ত সতর্ক হতে হবে। শিশুকে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করতে হবে যে, যাওয়া-আসার পথে যাঁরা দেখভাল করেন, তাঁরা কেউ তার গায়ে হাত দেন কি না, কোনও ভাবে তাকে আঘাত করেন কি না। বাচ্চা একা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়লে নজর রাখতে হবে। দেখতে হবে শিক্ষক কথায় কথায় তাকে অন্য ভাবে স্পর্শ করছেন কি না।
আমরা ক’জন খেয়াল রাখি, বাচ্চাকে স্নান করানোর নামে পরিবারেরই কেউ অযথা তার গোপনাঙ্গে হাত দিচ্ছে কি না, বা ভিড় বাসে বাচ্চার পিঠ বা কাঁধে কেউ তার যৌনাঙ্গ ঘসছে কি না? বিদেশে বহু জায়গায় কিন্তু রাস্তাঘাটে বাচ্চার গাল টেপার জন্যও অভিভাবকের অনুমতি নিতে হয়।
বাচ্চার মুড-সুইং, ভয় পাওয়া, হঠাৎ কান্না, চুপ করে যাওয়া, স্কুলে-কোচিংয়ে বা খেলতে যেতে না চাওয়ার মতো বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এই সব আচরণকে ছেলেমানুষি বলে উড়িয়ে দেওয়াটা বড় ভুল হতে পারে। শিশুকে এমন একটা ধারণা দিতে হবে যে পরিবারে, আপনজনের কাছে সে পুরোপুরি সুরক্ষিত, কেউ তাকে অকারণে মারতে বা বকতে পারবে না। সে যেন নির্ভয়ে মনের কথা খুলে বলে।
পাশাপাশি আর একটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক পরিবারের খুদে ছেলেটিকে ছোটবেলা থেকে মেয়েদের সম্মান করতে শেখাতে হবে। বীজ বপন শুরু করতে হবে এমন এক নতুন প্রজন্মের, যারা ছোট থেকে মেয়েদের দেহসর্বস্ব যৌনবস্তু ভাববে না। জানা-অজানা ‘গুড়িয়া’দের তালিকা ছোট করার একটা চেষ্টা পরিবারের চার দেওয়ালের মধ্যেই শুরু করা ভাল। নারী-নির্যাতনে সারা দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করা এই রাজ্যে শিশুদের খানিকটা নিরাপত্তা দেওয়ার একটা দায়িত্ব আমাদের আছে, তাই না?
|
তথ্য: চাইল্ড কেয়ার অ্যান্ড ইউ (ক্রাই), ওপেন, ভারত সরকারের মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক |