হাসান রোওহানির জয়ের সংবাদ আসিবার আগেই রাজধানী তেহরানের পথে পথে মানুষের ঢল, সহর্ষ জয়রব, উত্তাল উত্তেজনা। সেই উত্তেজিত জনতার মুখে প্রধানত যে শব্দটি উচ্চারিত হইতে শুনা গেল, তাহা ‘শান্তি!’ তাঁহারা শান্তি চাহেন, তাই রোওহানি জিতিতেছেন, এই তাঁহাদের বক্তব্য। এইটুকু হইতেই ইরানের সদ্য-সমাপ্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সারকথাটি আন্দাজ করা সম্ভব। হাসান রোওহানি নামে যে প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা এই বার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হইয়াছিলেন, এবং দেশের সংস্কারকামী সমাজের আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দু হইয়া উঠিয়াছিলেন, পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ভোট পাইয়া তিনিই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসাবে অভিষিক্ত হইলেন। অর্ধেক দেশের এই সমর্থনের মূল ভিত্তি— শ্বাসরোধকর বর্তমান হইতে মুক্তি ও শান্তির আশা। সত্যই কি রোওহানি তাহা দিতে পারিবেন? সম্ভবত সে প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচকই হইবে। কিন্তু এই মরিয়া, নাছোড়বান্দা আশাই যে ইরানের ২০১৩-র নির্বাচনে একটি বড় অঘটন ঘটাইয়া দিল। অঘটন, কেননা অপ্রত্যাশিত। অঘটন, তাই রোমাঞ্চকর।
কেন অপ্রত্যাশিত, তাহা ইরানের গত কয়েক দশকের ইতিহাসটি ফিরিয়া দেখিলেই বুঝা সম্ভব। এমনকী গত একটি দশকের ইতিহাসেই তাহা দৃঢ় ভাবে বিধৃত। দেশের রক্ষণশীল ইসলামি কর্তৃৃপক্ষ যে শক্ত হাতে ইরানি সমাজ ও রাজনীতির উপর রাশ ধরিয়া রাখিয়াছে, সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা খামেনেই-এর নির্দেশে নাগরিক সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত উত্থানের টুঁটি যে ভাবে নিষ্পেষিত হইয়াছে, তাঁহার অঙ্গুলিহেলনে চালিত দুই প্রতিষ্ঠান সিকিউরিটি কাউন্সিল এবং সামরিক বাহিনী ‘রেভলিউশনারি গার্ড’ যে ভাবে নির্দ্বিধ দমননীতি চালাইয়াছে, যে ভাবে ২০০৭-০৮ সালের সংস্কারকামী বিদ্রোহী মানুষদের উপর নির্মম অত্যাচার চলিয়াছে, এবং শেষ দুইটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের (২০০৫ ও ২০০৯) সময়ে যে ভাবে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে খামেনেই-প্রিয় আহমদিনেজাদই উপর্যুপরি প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হইয়া আসিয়াছেন, যে ভাবে নির্বাচনের মনোনয়ন-পত্র জমা পড়িবার সময় প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রফসানজানির মনোনয়ন বাতিল করিয়া দেওয়া হইল, তাহাতে এ বারও প্রবল আশঙ্কা ছিল যে, সংস্কারকামী শিবিরের পছন্দের নেতা রোওহানিকে কোনও না কোনও ভাবে নির্বাচনে হারাইয়া দেওয়া হইবে। আন্তর্জাতিক দুনিয়াতেও জল্পনা ছড়াইতেছিল যে এ বারও সেই উপরি-মহলের নিয়ন্ত্রণই কায়েম থাকিবে। না। তেমন ঘটিল না। জল্পনা, আশঙ্কা সব ভুল প্রমাণ করিয়া রোওহানিই জিতিলেন।
সন্দেহাতীত ভাবে এই জয় সম্ভব হইল ধর্মীয় ও রক্ষণশীল রাজনীতির উপরিমহল এ বার কোনও কারণে ভোটের ফলাফল নির্ধারণ হইতে নিজেদের সরাইয়া রাখিলেন বলিয়াই। কোন হিসাব কষিয়া তাঁহারা এই কাজ করিলেন, তাহা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট। ইহা সেই উপরিমহলের দুর্বলতা নহে, ইহা নিতান্তই কোনও-এক প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক হিসাব। সম্ভবত সেই হিসাব বলিতেছে: মার্কিন ও অন্যান্য পশ্চিমি দেশগুলির দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরানের জনসাধারণের যে ত্রাহি-ত্রাহি পরিস্থিতি, সিরিয়ার যুদ্ধের ফলে সীমান্তের ঠিক পরপারে যে অগ্নিগর্ভ সংঘর্ষ, গত দশ বৎসর যাবৎ প্রেসিডেন্ট আহমদিনেজাদের উপর্যুপরি পরমাণু-রণহুঙ্কারের ফলে বিশ্বময় ইরানের যে দুর্নাম, তাহার প্রেক্ষিতেই আপাতত নির্বাচনে সংস্কারপন্থী দলকে নিষ্পেষণ না করাই ভাল। বরং নির্বাচন-উত্তর পর্বের নীতি-নির্ধারণের সময় দেখা যাইবে কাহার জিত, কাহার নহে। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, উপরমহলের সিলমোহর ব্যতীত কোনও নীতিই ইরানের প্রেসিডেন্টের একার পক্ষে নির্ধারণ করা সম্ভব নহে। সুতরাং মৌলবাদী রক্ষণশীল শক্তিকে তোয়াজ করিয়াই রোওহানিকে চলিতে হইবে, ইহার ব্যত্যয় ঘটিবে না। তৎসত্ত্বেও হয়তো পরমাণু নীতি-নির্ধারণে কিছু নমনীয়তা, পশ্চিমের সঙ্গে কিছু সমঝোতা তিনি করিতে পারিবেন। আঞ্চলিক সংঘর্ষ কমাইবার পক্ষে ওকালতি করিতে পারিবেন। ভারতের মতো আঞ্চলিক প্রতিবেশী দেশের ভূমি হইতে দেখিলে তো বটেই, সামগ্রিক নিরিখেও এইটুকু আশার আলোকও বড় কম নহে। রোওহানির কঠিন যাত্রাপথের জন্য তাই স্বাগতবার্তা রহিল। |