গ্রামের মেয়েটাকে নৃশংস ভাবে খুন হয়েছে। দোষীদের সাজা চাইলেও রাজনীতি চায়নি গাইঘাটার রাজাপুর গ্রাম। ঠিক যেমন চায়নি বারাসতের কামদুনি। রাজনীতি কিন্তু ঢুকেই পড়ল! চাপানউতোরে জড়িয়ে পড়লেন রাজ্য ও কেন্দ্রের মন্ত্রী।
কামদুনিতে কলেজ ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার সঙ্গে গাইঘাটায় ছাত্রী-খুনের ঘটনা এক নয় বলে রবিবার বিতর্কিত মন্তব্য করলেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তাঁর যুক্তি, গাইঘাটার ষষ্ঠ শ্রেণির মেয়েটিকে নৃশংস ভাবে খুন করা হলেও ধর্ষিতা হয়নি সে। রাজাপুর গ্রামে দাঁড়িয়েই তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “পারিবারিক রেষারেষি জেরেই এই ঘটনা ঘটেছে। কামদুনির ঘটনার সঙ্গে এই ঘটনার মিল নেই। ময়না-তদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, কোনও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। তবে, দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।” যা শুনে জ্যোতিপ্রিয়বাবুর পরে ওই গ্রামে যাওয়া কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী তথা কংগ্রেস সাংসদ দীপা দাশমুন্সির বক্তব্য, “কামদুনির সঙ্গে আলাদা করে করে দেখিয়ে আসলে গাইঘাটার ঘটনাটিকে লঘু করতে চাইছে তৃণমূল।” |
কামদুনির ঘটনায় রাজ্যের শাসক দল ইতিমধ্যেই যথেষ্ট অস্বস্তিতে। সরকারি সাহায্য, চাকরির ও ক্ষতিপূরণের আশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে নিহত কলেজ ছাত্রীর পরিবার সেই অস্বস্তি আরও বাড়িয়েছে। একই জেলার (উত্তর ২৪ পরগনা) আর এক প্রান্ত গাইঘাটাতেও সরকারি সাহায্য প্রত্যাখ্যান করেছে নিহত ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীর পরিবার। স্বভাবতই জোড়া বিড়ম্বনায় সরকার তথা তৃণমূল। বিরোধীদের দাবি, সরকারের মুখ রক্ষা করতেই গাইঘাটা-কাণ্ডকে কামদুনির সঙ্গে পৃথক করে দেখানোর চেষ্টা করছে তৃণমূল।
শুক্রবার এলাকার পাটখেত থেকে বাঁ চোখ ওপড়ানো ও বাঁ কানের কিছুটা অংশ ছেঁড়া অবস্থায় রাজাপুর কলোনির বছর বারোর স্কুলছাত্রীর দেহ মেলে। রবিবার বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ নিহত ছাত্রীর মামাবাড়িতে আসেন জেলা তৃণমূল পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয়বাবু। সঙ্গে ছিলেন বনগাঁ দক্ষিণের তৃণমূল বিধায়ক সুরজিৎ বিশ্বাস ও জেলা পরিষদের তৃণমূল সদস্য সুভাষ রায়। কামদুনির ঘটনার দিন এলাকায় গিয়ে স্থানীয় মানুষের ক্ষোভের সামনে পড়ে ফিরে আসতে হয়েছিল জ্যোতিপ্রিয়বাবুকে। এ দিন অবশ্য সেই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি তাঁকে। তবে, মন্ত্রী আসার আগে স্থানীয় তৃণমূল নেতারা নিহত স্কুলছাত্রীর বাড়িতে ঘুরে যান।
নিহত কিশোরীর মা ছেলেকে নিয়ে আপাতত বাপের বাড়িতে উঠেছেন। খাদ্যমন্ত্রীর কাছে মেয়েটির মা ও মাসিরা দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানান। মন্ত্রী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী আমাদের পাঠিয়েছেন। আপনারা যেটা চাইবেন, সেটাই হবে। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কেউ ছাড়া পাবে না।” নিহতের পরিবার ও স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, খুনের ঘটনায় আরও কেউ জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু সঞ্জয় মণ্ডল নামে প্রতিবেশী এক যুবককে ধরে তাঁরা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পরে নতুন করে আর কাউকে ধরা হয়নি। এলাকায় গাঁজার ঠেক ও দেশি মদ বিক্রি বন্ধের দাবিও ওঠে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত গাইঘাটার ওসিকে গাঁজা-বেআইনি দেশি মদ বিক্রি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন খাদ্যমন্ত্রী।
বেলা আড়াইটে নাগাদ রাজাপুরে আসেন দীপা দাশমুন্সি। সঙ্গে ছিলেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি দেবী ঘোষাল, দলীয় নেতা তাপস মজুমদার ও সম্রাট তপাদার। নিহতের মা ও মাসি দীপাদেবীকে বলেন, “খুনিরা ছাড়া পেলে আমরা বাঁচব না।” কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে জানানো হয়, পুলিশ নিহতের পরিবারের কথা শুনে এফআইআর লেখেনি। দীপাদেবী এফআইআরের কপি নিয়ে পড়ে জানান, যে ভাবে অভিযোগ লেখা হয়েছে, তাতে দোষীদের কঠোর শাস্তি সম্ভব নয়। মেয়েটির পরিবার জানায়, এক আত্মীয়কে থানায় ডেকে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয় পুলিশ। পরে অন্য কাউকে দিয়ে অভিযোগ লেখানো হয়। অস্বস্তিতে পড়ে মন্ত্রীর সামনে ওসি অরিন্দম মুখোপাধ্যায় জানান, বাড়ির লোকের অতিরিক্ত বক্তব্য থাকলে, তা-ও এফআইরে নথিভুক্ত করা হবে।
এ দিনই সকালে সুঁটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চের পক্ষ থেকে গাইঘাটা থানার সামনে দোষীদের গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ দেখানো হয়। রাজাপুর বাজার এলাকার বাসিন্দারাও সই সংগ্রহ করে গাইঘাটা থানায় স্মারকলিপি দেন। এই ঘটনা নিয়ে মানবাধিকার কমিশনে যাবেন জানিয়ে দীপাদেবীর মন্তব্য, ‘‘আগে এ ধরনের ঘটনা থেকে তৃণমূল রাজনৈতিক ফায়দা তুলে এসেছে। কিন্তু, এখন ওদেরই নাম জড়িয়ে যাচ্ছে।” খাদ্যমন্ত্রীর পাল্টা বক্তব্য, “কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন দল এই ঘটনা নিয়ে পঞ্চায়েত ভোটের আগে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছে।” না চাইতেও রাজনীতি জড়িয়ে যাচ্ছে। নেতা-নেত্রীদের আনাগোনাকে খুব সাদা চোখে দেখছেন না রাজাপুরের মানুষ। অনেককেই বলতে শোনা গেল, “সামনে পঞ্চায়েত ভোট। না হলে কি ওঁরা এই তল্লাটে এমন ছুটে আসতেন?” |