সম্পাদক সমীপেষু...
উদাসীনতা থেকেই ভুল বানান
দ্বিতীয় সম্পাদকীয় ‘ভূল’ (৫-৬) প্রসঙ্গে এই চিঠির অবতারণা। গাঁধীজি যে ‘কেটল’ বানান ভুল করেছিলেন সে কথা তাঁর আত্মজীবনীতেও আছে। হুগলি নর্মাল স্কুলের শিক্ষক পদপ্রার্থী মধুসূদন পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে সহপাঠী বন্ধু ভূদেব মুখোপাধ্যায়কে পৃথিবী বানানটি জিজ্ঞেস করেন। ভূদেবের মুখে নির্ভুল বানান শুনেও কিন্তু মধুসূদন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে ওঠেন ওহ্ নো, ইট মাস্ট বি প্র-থি-বী। চলন্তিকা অভিধানকার রাজশেখর বসু শিল্পী যতীন্দ্রমোহনকে নির্দেশ দিতে গিয়ে লিখেছিলেন,‘হাসী-মুখ’। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এক বার মূর্ধন্য বানান ভুল করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে আলমোড়া থেকে তিনি পুলিনবিহারী সেনকে চিঠিতে লেখেন ‘কল্যাণীয়েষু, মূর্ধন্য কথাটায় আমি ণ ব্যবহার করেছি, ওটা ভুল।’ বানান ভুলের ব্যাপারে বোধহয় শেষ কথা বলেছেন অবনীন্দ্রনাথ। তাঁর ঘরোয়া গ্রন্থের প্রকাশ কালে তাঁর হাতের লেখার ব্লক করার পর দেখা গেল সেখানে একটি বানান ভুল আছে। কুণ্ঠার সঙ্গে তাঁকে সে কথা জানাতে তিনি জবাব দেন ‘স্পেলিং মিস্টেক? ও কারবার আমার নয়। স্পেলিং দিয়ে কী করব। আমি স্পেলবাউন্ড করি’।
মুদ্রিত গ্রন্থের বানান ভুলকে আমরা ‘ছাপাখানার ভূত’ আখ্যা দিয়ে দায় এড়াতে পটু। বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বাংলা বানানের যে উদারীকরণ চোখে পড়ে তার দায় কার ওপর বর্তাবে? আমাদের মতো ছাত্রছাত্রীরা হলে না-হয় পরীক্ষকের হাতে কাটা পড়ত। আসলে ভাষার প্রতি চিরাচরিত উদাসীনতা থেকেই ভুল বানানের উৎপত্তি। আজকাল কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় প্রকাশ্য জনসমক্ষে ‘ব্যবহারিক’ ও ব্যাবহারিক’ দুটি বানানই দাপটের সঙ্গে মুদ্রিত গ্রন্থের মলাটে শোভা পাচ্ছে। সরকারি বিজ্ঞাপনে অনায়াসে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’ বা ‘সম্মানীয়’ লেখা হলে গঞ্জের মোড়ে ‘দূর্গা বস্ত্রালয়ে’র আর দোষ কী? প্রতিদিন দূরদর্শন আর সংবাদপত্রের পাতায় একই শব্দের একাধিক বানান দেখতে দেখতে আমাদের মতো এখনও পড়ুয়ারা গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেয়ে মরছি। সরকারি উদ্যোগে ‘ভাষা রক্ষা কমিটি’ গঠিত না-হলে বাংলা বানানের বেহাল দশা আটকানো যাবে না। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এক সময় এই ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী হয়েও সুদূরপ্রসারী সফলতা অর্জন করতে পারেননি। সাধারণ শিক্ষিত মানুষ বা লোকসাধারণ এই সর্বশিক্ষা অভিযানের যুগে আধুনিক গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, হোর্ডিং ইত্যাদি থেকেই বানান শেখে। কিন্তু এ সব ক্ষেত্রে নির্বিচারে ভুল বানান লেখা হচ্ছে। ২১ ফেব্রুয়ারি দূরদর্শনে খোদ বাংলাদেশের শহিদ মিনারে ফুলের তোড়ায় ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’ লেখা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। যাঁরা বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন তাঁরা কি শুধু কথ্যভাষার মুক্তির জন্য লড়াই করেছিলেন?
আমার মনে হয়, অশুদ্ধ বানান ভাষাকে অবনমনের পথে নিয়ে যায়। জাতির বিশৃঙ্খলাকেই প্রকট করে তোলে। একই শব্দের একটাই বানান মান্যতা পাক এটাই আমাদের কাম্য। তার জন্য বাংলার তামাম শিক্ষাবিদ ও সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। আর তা না-হলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মর্যাদা হানি ঘটবে।
উল্টো ভাষা পাল্টা উচ্চারণ
ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উল্টো ভাষা পাল্টা উচ্চারণ’ (২৪-৫) প্রসঙ্গে এই চিঠি। সত্যিই আজকালকার বাঙালি ছেলেমেয়েরা শুধু নিজেদের নামই নয়, সব বাংলা শব্দই একটু হিন্দি বা ইংরেজি ঘেঁষা ভাবে উচ্চারণ করে বোধহয় প্রমাণ করতে চায় যে, ওরা ভেতো বাঙালি নয়, অনেক বেশি আধুনিক এবং কেতাদুরস্ত। তবে দুঃখের বিষয়, অনেক প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যেও এই প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। শুধু উচ্চারণেই নয়, ভাষার ব্যবহার বা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও কিন্তু নানা রকম ভুল হরদম শোনা যায় বা চোখে পড়ে। একটা উপমা দিই, আজকাল টেলিফোন করে বলা হয়, ‘আমি অমুক বলছিলাম’ এটা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ, ‘বলছিলাম’ অতীতকালকে বোঝায়। অথচ যিনি টেলিফোন করছেন, তিনি তখন কথা বলছেন। সঠিক প্রয়োগবলছি, present continuous tense. আরেকটি উদাহরণ, ‘আমার ঘরে এটা আছে’, ‘ঘরে বসে শেখো’ ইত্যাদি। ঘর বলতে বোঝায়, ইংরেজিতে যাকে বলে room. এ ক্ষেত্রে বলা উচিত ‘বাড়ি থেকে’ অর্থাৎ from home.
চন্দ্রবিন্দু তো বাংলা ভাষা থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে। যার ফলে, কতগুলি নতুন কথার সৃষ্টি হয়েছে। ওঁরা হয়ে গেছে ‘ওনারা’ বা ওঁদের হচ্ছে ‘ওনাদের’। এই দুটি শব্দ বাংলায় ২৫ বছর আগেও ছিল কি না মনে করতে পারছি না।
এই রকম সমানে বিকৃত উচ্চারণ আর অপপ্রয়োগের ফলে আমাদের এমন সুন্দর ভাষা আজ থেকে ১৫-২০ বছর পরে কী দাঁড়াবে ভাবতে ভয় হয়।


প্রখ্যাত আবৃত্তি শিল্পী ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উল্টো ভাষা পাল্টা উচ্চারণ’! (২৪-৫) পড়ে ভাল লাগল। মূল সমস্যাটা হল, এই প্রজন্মের বাবা-মায়েরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের বেশি স্মার্ট তৈরি করতে গিয়ে প্রথম কোপটা দেন বাংলা ভাষার উপর। মাতৃভাষার উপরেই তাঁদের যত বিতৃষ্ণা। বাংলার বদলে ভুল ইংরেজি বা ভুল হিন্দি-তে কথা বলাটাই এখন চলতি ‘ট্রেন্ড’।
এ ক্ষেত্রে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ না-করে পারছি না। বছর কয়েক আগে দক্ষিণ কলকাতার একটি বিখ্যাত পুজোয় সপরিবার প্রতিমা দর্শনে গিয়েছি। সুসজ্জিত মণ্ডপের একপাশে হাওয়া-ভরা প্রকাণ্ড এক রঙিন মিকি মাউসের উপর দিয়ে বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে। আমার মেয়েও আছে তাদের দলে। একটি নিতান্তই ছোট শিশু আমার মেয়ের পাশে হামাগুড়ি দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল। বারবার টাল সামলাতে না-পেরে সে যখন পড়ে যাচ্ছিল আমি মেয়েকে ইশারায় শিশুটিকে সাহায্য করতে বলি। হঠাৎ আমার পাশেই দাঁড়ানো এক সুবেশ ভদ্রলোক ওই শিশুটিকে হাঁটতে উৎসাহ দিয়ে বলতে থাকেন, ‘বেটা ওয়াক্ করো, বেটা ওয়াক্ করো’। আমার মেয়ে ওই ভদ্রলোকের চিৎকার শুনে দ্রুত শিশুটিকে ছেড়ে দিয়ে নীচে নেমে আসে। আমি বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকালে সে বলে ওঠে, ‘বাবা, ওর বাবা ওকে বমি করতে বলছে বলে আমি ভয়ে নেমে এলাম’। সত্যি, একই বাক্যে এ রকম তিনটি ভাষার ব্যবহার আমার জীবনে এক বিরল অভিজ্ঞতা। এ রকম ভাষার প্রয়োগে সত্যিই বিবমিষার উদ্রেক হয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.