তৃতীয় মোর্চা লইয়া আবার এক দফা তৎপরতা শুরু হইয়াছে। লোকসভা নির্বাচন আসন্ন হইলেই অ-কংগ্রেসি ও অ-বিজেপি জোটের শরিক হইয়া কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার সম্ভাবনা খতাইয়া দেখাটা বিগত তিন দশক ধরিয়া ভারতীয় রাজনীতির দস্তুর। কেন্দ্রে কংগ্রেসের একাধিপত্যের অবসান এবং দ্বিতীয় জাতীয় দল হিসাবে ভারতীয় জনতা পার্টির উত্থানের পর হইতেই প্রধানত বামপন্থীদের উদ্যোগে তৃতীয় বিকল্পের ধারণাটি দানা বাঁধিতে শুরু করে। কিন্তু অন্তত চার দফায় (জনতা পার্টি, চন্দ্রশেখর, দেবগৌড়া ও ইন্দ্রকুমার গুজরালের নেতৃত্বে) কেন্দ্রে অ-কংগ্রেসি জোটের সরকার গঠিত হইলেও নিয়তির পরিহাসে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের সমর্থন প্রত্যাহারের ফলেই সরকারগুলির অকালমৃত্যু ঘটে। অতঃপর বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ-র ক্ষমতাসীন জোটের ভিতরে কিংবা বাহিরে প্রায় সকল আঞ্চলিক দলই সমাবেশিত হইয়া যাওয়ায় তৃতীয় বিকল্পের ধারণাটিই ক্রমে প্রাসঙ্গিকতা হারায়।
এখন যে নূতন করিয়া তাহা আলোচিত হইতেছে, তাহার কারণ, ওই দুই জোটের কেহই আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনে গরিষ্ঠতা অর্জনে সফল হইবে কিনা, সে সংক্রান্ত সন্দেহ। তা ছাড়া দুই জোটের কোনওটিতেই অন্তর্ভুক্ত নয়, অথচ আঞ্চলিক দল হিসাবে বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতাসীন, এমন রাজনৈতিক সংগঠনগুলির দরকষাকষির ক্ষমতাও উত্তরোত্তর বাড়িতেছে। এক দিকে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন এ বারের তৃতীয় মোর্চার (‘যুক্তরাষ্ট্রীয় মোর্চা’) আহ্বায়ক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করিতে তৎপর হইয়াছেন, অন্য দিকে বাম দলগুলিও আর একটি বিকল্প জোটের সম্ভাবনা খতাইয়া দেখিতেছে। লক্ষণীয়, রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাস ও অর্থনৈতিক তহবিলের বিলিবণ্টন উত্তরোত্তর কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠীর দ্বারা সঙ্কুচিত হওয়ায় রাজ্যে-রাজ্যে ক্ষমতাসীন আঞ্চলিক দলগুলি শাসন পরিচালনায় যে অসুবিধার সম্মুখীন হইতেছে, তাহা হইতে পরিত্রাণের ভাবনাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাবিত মোর্চাটির নিহিত তাগিদ। অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও চন্দ্রবাবু নায়ডুর মতো তৃতীয় মোর্চার আদি শরিকরাও তৃণমূল নেত্রীর সহিত যোগাযোগ করিতেছেন, উৎসাহ দেখাইতেছেন। আবার জগন্মোহন রেড্ডির মতো বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসি নেতার সঙ্গেও যোগাযোগ করা হইতেছে। বামেদের প্রস্তাবেও হয়তো অপরাপর আঞ্চলিক দলের উৎসাহ ঘটিবে। লোকসভা নির্বাচন যত নিকটবর্তী হইবে, তৃতীয় মোর্চা লইয়া আঞ্চলিক দলগুলির তৎপরতা ততই রুদ্ধশ্বাস হইবে।
প্রশ্ন হইল, ধারণা হিসাবে তৃতীয় মোর্চা যত আকর্ষকই হউক, বাস্তবে তাহার রূপায়ণ কি সম্ভব? কেন্দ্রে অ-কংগ্রেসি দলগুলির জোটের পরিণাম দেশবাসীর চোখের সামনে রহিয়াছে। এক বারই এই জোট জয়প্রকাশ নারায়ণের পৌরোহিত্যে এবং জনতা পার্টির ছত্রছায়ায় কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হয়। কিন্তু কে প্রধানমন্ত্রী হইবেন, সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মোর্চার অভ্যন্তরীণ সংহতি নষ্ট হইয়া যায়। জয়প্রকাশের ব্যক্তিত্বের কাছে নত হইয়া শরিকরা প্রথমে মোরারজি দেশাইকে শিরোধার্য করিলেও পরে সব লণ্ডভণ্ড হইয়া যায়। ইন্দিরার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংহত জনতা সরকার শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা কংগ্রেসের সমর্থন লইয়া চৌধুরী চরণ সিংহকে প্রধানমন্ত্রী বানায়, তিন মাসের মধ্যে ইন্দিরা সমর্থন তুলিয়া লইলে যাহা ভাঙিয়া পড়ে। এখনও যে তৃতীয় মোর্চার প্রস্তাব শুনা যাইতেছে, ঘটনাচক্রে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হইলে তাহার প্রধানমন্ত্রী কে হইবেন? মুখে সকলেই বলিতেছেন, তাঁহারা ক্ষমতার জন্য লালায়িত নন। কিন্তু মুলায়ম সিংহ যাদব, নীতীশ কুমার, জয়ললিতা (কিংবা করুণানিধি), চন্দ্রবাবু নায়ডু, নবীন পট্টনায়ক অথবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গদি নাগালে পাইয়াও সমান নির্লোভ থাকিবেন তো? পারস্পরিক বিবাদেই তো তাঁহাদের সময় কাটিবে। বর্তমান ইউ পি এ জোটই শরিকি চাপে অকর্মণ্য হইয়া পড়িয়াছিল, তৃতীয় জোট আদৌ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত লইতে পারিবে তো? সরকার পাঁচ বৎসর অতিবাহন করিবার শক্তি জোগাড় করিতে পারিবে তো? তত্ত্বগত ভাবে তৃতীয় মোর্চার ধারণাটি যুক্তিসঙ্গত হইলেও তাহার বাস্তব রূপায়ণ লইয়া সমস্যা থাকিয়াই যাইবে। |