ভুল গান গেয়ে ভাসিয়ে দেব না নিজেকে

ভারতবর্ষের গায়ক হতে চেয়ে নৈহাটিতে কেন পড়ে রইলেন?
নৈহাটি আমার শহর, যা আমার কাছে আমার লিভিংরুম। এ রকম একটা জায়গা তো থাকবে, যেখানে বারমুডা পরে সর্ষের তেলের ‘মামলেট’ থেকে স্বার্থহীন বন্ধুদের সঙ্গে চা-মুড়ি খেতে পারি। এটা আমার কাছে খুব জরুরি। ঠিক একই রকম ভাবে জরুরি আমার মায়ের উপস্থিতি, যাঁর শর্তহীন ভোরের নিয়মিত সঙ্গীত চর্চা আমাকেও নিয়মের রেওয়াজে উদ্বুদ্ধ করে। প্রত্যেক দিন নিজেকে নতুন করে তৈরি করতে চেষ্টা করি। এই পরিবেশই আমায় গাইতে শিখিয়েছে। তাঁকে ছাড়া আর গান ছাড়া আমার কাছে একই। তবে হ্যাঁ, এর জন্যে দশটার জায়গায় পাঁচটা কাজ পাই আমি।

আপনার কি মনে হয় না এই রকম কাজ পাওয়ার কারণ আপনার দুর্বল পি.আর?
দেখুন সত্যি কথা বলতে এই পি.আর.জিনিসটা কী ভাবে করতে হয়, আমি আজও জানি না। শুধু তাই নয়, আমি মদও খাই না। প্রোডিউসার, ডিরেক্টরদের মদের আড্ডায় যে ধরনের কাজ ধরা-ছাড়ার খেলা চলে, আমি সেটা থেকেও বঞ্চিত। আমি মদ খাই না বলে কেউ আমায় তেমন আড্ডায় ডাকেও না। আর নিজে থেকেও কাউকে বলতে পারি না আমায় কাজ দাও।

আনন্দplus-এর জন্যে সাক্ষাৎকার দিতে এসেও বৌকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন! আপনার মহিলা ফ্যানের সংখ্যাও তো এমন করলে কমতে থাকবে। আপনার কী মনে হয়?
(প্রচণ্ড হেসে) নাহ্, আসলে আমি এখনও মহিলাদের সঙ্গে ফ্লার্ট করতে শিখলাম না। প্রেমের ব্যাপারে একেবারেই বোকাসোকা হয়ে আছি। তবে দেখি এ বার (বৌয়ের দিকে তাকিয়ে) ওর সঙ্গে একটা মিউচ্যুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং করে গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যা বাড়াব।

এমন কোনও গান আছে, যা শুনে মনে হয়েছে এটা আপনি গাইলে আরও ভাল গাইতে পারতেন?
মুম্বই থেকে কুণাল গাঞ্জাওয়ালাকে দিয়ে যখন বাংলা গান গাওয়ানো হয়, তখন মনে হয় ওঁর এই গানগুলো আমি অনেক ভাল গাইতে পারতাম। ওঁর কণ্ঠ ভাল, কিন্তু উচ্চারণ খুব খারাপ। জিৎ গাঙ্গুলি যখন ওঁকে দিয়ে ‘যখন দেখা হয়েছিল’ গাওয়ালো, ওই উচ্চারণ শুনে মনে হয়েছিল আমি হয়তো নিজের ভাষায় এই গানের প্রতি অনেক বেশি সুবিচার করতে পারতাম। জিৎ আমাকে দিয়েও অনেক গান গাইয়েছেন। কিন্তু দেখুন, আমরা তো একটা সেলেবেল আইটেম, আমাদের গান লোকে ভালবাসে, বাজারে পয়সা দিয়ে লোকে আমাদের গান কেনে। তা হলে কেন অবাঙালিদের দিয়ে বার বার বাংলা গান গাওয়ানো হয়?

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
টলিউডে এখন বাঁধাধরা লবি আছে। যেমন সৃজিত-অনুপম, ইন্দ্রদীপ বা জয়-শ্রীজাত-শ্রেয়া অন্য দিকে দেবজ্যোতি মিশ্র, আপনি কোন লবির?
দেখুন আমি কোনও নির্দিষ্ট লবির নই। এতে করে একটা সুবিধা হয়েছে যে কোনও লবিতেই প্রয়োজন মতো আমার ডাক আসে। আজও ইন্ডাস্ট্রিতে দশটা সিনেমা হলের ছ’টাতেই আমার গান থাকে। আর আপনি যাঁদের কথা বললেন, যেমন দেবজ্যোতি মিশ্র, তিনি বলা যেতে পারে আমার গডফাদার। ওঁর জন্যেই ‘দেবদাস’-এ গান গাওয়ার সুযোগ আসে আমার। অথচ এর জন্যে কিন্তু আলাদা করে সঞ্জয় লীলা বনশলির সঙ্গে আমায় পি.আর.করতে হয়নি। দেবজ্যোতি মিশ্রর পরিচালনায় ‘মেঘে ঢাকা তারা’-তেও এ বার গান গেয়েছি। আর ইন্দ্রদীপ যখন ইন্দ্রদীপ হয়ে ওঠেনি, চিরদীপ ছিল, তখন থেকে ওর সঙ্গে গান গাইছি আমি। বলা যেতে পারে আমার গানের মধ্যে দিয়েই ওর চিরদীপ থেকে ইন্দ্রদীপ-এ উত্তরণ। জয় সরকারের পরিচালনায়, কঙ্কনা চক্রবর্তীর ডকু-ফিচারে আমি গান গেয়েছি যেখানে অমিতাভ বচ্চন ভাষ্যপাঠের দায়িত্বে ছিলেন। অমিতাভ বচ্চন নিজে আমার গান শুনে পছন্দ করেছেন। এটা আমার জীবনের বড় পাওয়া। অনুপমের সঙ্গেও কাজ করেছি অনেক। তবে ইন্ডাস্ট্রিতে আমার একটা ইমেজ আছে। যে কোনও শক্ত গান, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আধারের কোনও ক্রিটিকাল গান থাকলেই আমার ডাক আসে। আমি জানি ওটা আমায় ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে হবে না।

কিন্তু এই যে শক্ত গান গাওয়ার ইমেজ, আমার তো মনে হয় এই ইমেজই আপনার কম কাজ পাওয়ার অন্যতম কারণ। বলা হয় রাঘব সফ্ট রোম্যান্টিক গান গাইতে পারে না কেবল বোল্ড শক্ত গান গায়। আপনার কী মনে হয়?
এটা আগে বলা হত। এখন কিন্তু আমি নিজেকে বদলে ফেলেছি। যেমন ধরুন আমি রবীন্দ্রনাথের গানের অ্যালবাম করলাম ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’, যা সুপারহিট। নজরুলগীতিও করলাম। অন্যান্য অনেক সফ্ট রোম্যান্টিক গানও গাইছি এখন।

আপনাকে অনেক গানেই তান ব্যবহার করতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথের গানে করলেন না কেন?
(বিস্ময়ের সঙ্গে) পাগল নাকি! আমি রবীন্দ্রনাথের গানের শিল্পী নই। শিখিনি কোথাও। তবে রেকর্ডিংয়ে শ্রীকান্তদা আর প্রত্যুষ খুব সহযোগিতা করেছে। এখানে একজন কম্পোজার নিজেই নিজের গান যখন বেঁধে দিয়ে গিয়েছেন, সেখানে সুর, কথা বদল বা তান দিয়ে গাওয়ার অধিকার আমার নেই। যেমন নজরুলের গানের ক্ষেত্রে নজরুল সে ভাবে কিছু বলে যাননি বলে আমি নজরুলগীতি গাইলে অনেক স্বাধীন ভাবে গাই। কোথাও তারানা জুড়ে দিলাম, তো কোথাও তান দিলাম। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তা করা যায় না।

অজয় চক্রবর্তীর মতো শিল্পীকেও রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে তান ব্যবহার করায় সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আপনি কী বলেন?
দেখুন রবীন্দ্রনাথের গান তো আর খেয়াল নয়। আর আমি খেয়াল জানি বলে সব গানই খেয়ালের মতো করে গাইব এমনটাও নয়। অজয় চক্রবর্তীর মতো গানের মাঝে বিস্তার বা তান দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান আমি গাইনি আর গাইবও না। যেমন ধরুন ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ গানটি একটি বৃষ্টির গান। সেখানে ঠিক শুরুতে একটা ছোট্ট তারানা ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু সেটা মিউজিক্যালি ব্যবহার করা হয়েছে। গানের মাঝে কোথাও অন্য রকম কিছু ব্যবহার করা হয়নি। দেখুন, একটু নতুন রকমের ভাবনা না থাকলে যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান প্রচুর শিখেছেন, যাঁরা আমার থেকে ভাল গান, লোকে তাদের গান কিনবে। আমারটা শুনবে কেন?

এমন কোনও অভিজ্ঞতা আছে যে গান রেকর্ড করতে যাওয়ার দিন রেকর্ডিং ক্যান্সেল হয়েছে, অন্য কেউ সেই গান গেয়ে দিয়েছেন?
(একটু ভেবে) এটা বলার আগে বলে নিই কারও প্রতি বিদ্বেষ নিয়ে আমি মিডিয়ার কাছে মুখ খুলছি তা কিন্তু একেবারেই নয়। এটা আমি আমার খারাপ লাগার জায়গা থেকে, ভাল গান হারানোর জায়গা থেকে বলছি। অটোগ্রাফ-এ ‘যদি কেড়ে নিতে বল’ গানটা আমার গাওয়ার কথা ছিল। রেকর্ডিংয়ের দিন সকালে আমাকে বলা হয় একটি বিশেষ কারণে গানটা অন্য কেউ গাইবেন।
কিন্তু এর জন্যে দেবজ্যোতি মিশ্র বা সৃজিতকে আমি দোষারোপ করছি না। নিশ্চয়ই কোনও অসুবিধা ছিল সেখানে। সৃজিত পরে একটা পার্টিতে বলেওছিল যে ‘রাঘবদা, আমারও খুব খারাপ লেগেছে। আমার পরের ছবিতে তুমি অবশ্যই থাকবে।’ সৃজিত কথা রেখেছিল। বাইশে শ্রাবণের শীর্ষসঙ্গীতটাই আমার।


অনুপমের গান কেমন লাগে?
খুব ভাল। খুব বাস্তববাদী ছেলে। ওর কথার মধ্যেও গভীরতা আছে। ‘বাইশে শ্রাবণে’ ‘মাটি খুঁড়ে’ গানটা যে ভাবে আমায় দিয়ে ও গাইয়েছিল, আমি ভাবতেই পারিনি ও এ রকম গান বানাতে পারে। এই গানটা নিয়মিত এখন অনুষ্ঠানে আমায় গাইতেই হয়।

রাঘব বললেই ‘চাঁদ কেন আসে না’ কিন্তু তার পরে অন্য কোনও গান সে ভাবে এল না কেন?
নাহ্ অনেক গান আছে। যেমন ‘ঝিরিঝিরি’, ‘তোমার চোখে আমি আমার মরণ দেখেছি’, ‘তুমি নেই বলে’। আসলে প্রত্যেক শিল্পীর ক্ষেত্রেই কয়েকটা গান একেবারে শ্রোতাদের মনে থেকে যায়। সেটাকে ছাপিয়ে যাওয়া মুশকিল। যেমন মান্না দে। মান্না দে বললেই মনে হয় ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’। মান্না দে যে ধরনের গান গেয়েছেন, তাঁর কাছে এটা কিন্তু নিতান্তই সাধারণ একটা গান। তার মানে তো এমন নয় যে মান্না দে আর তেমন ভাল গান গাননি।

মুম্বইতে টিকতে পারলেন না কেন?
মুম্বই খুব নির্মম শহর হয়ে গিয়েছে। কেউ ভীষণ ভাল গান করুক বা কেউ খুব খারাপ গান করুক, কাউকেই মুম্বই টানা অনেক দিনের জন্যে নিতে পারে না আর। ভাল শিল্পীর কদর থাকলে মুম্বইতে মিকা সিংহ, আতিব ইসলাম, হিমেশ রেশমিয়ার মতো শিল্পীরা গান গাইতে পারত না। ইউটিউবে মিকা সিংহের গানের এক মাসে দেড় কোটি লাইক হয়। আর সেখানে সোনু নিগমের একটা অসাধারণ গানে দেড় হাজার লাইক।
এখন আসলে শিল্পী নয়, গান হিট করে। যদিও গানের মতো গানই বা ক’টা হয়? চার পাঁচটা লাইনকে নানা ভাবে সাজিয়ে দেওয়া হয় এখন। মিকা সিংহ একেকটা অনুষ্ঠানের জন্যে চল্লিশ লক্ষ টাকা পান। ভাল গানের পরিসরই আসলে কমে আসছে। তাই আমি মনে করি মুম্বইতে গানের জন্যে আলাদা করে থাকার কোনও দরকার নেই। দরকার হলে জানি শান্তনুদা আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে গান গাওয়াবেন।


আপনি নিজে গান লিখেছেন কখনও?
লেখার চেয়ে সুর নিয়ে খেলতেই আমি বেশি পছন্দ করি। সঙ্গীত পরিচালনার ইচ্ছেও আছে আমার। কিন্তু সেটাও বেছে বেছে। আমি গায়ক হয়েই মানুষের মনে থাকতে চাই। আমি হয়তো খুব কম জানি, আমি বিরাট শিল্পীও নই। কিন্তু আমার যে নিজস্বতা আছে সেটা অন্য কোনও ভাবে রিপ্লেস করা যাবে না, এটা সবাই বোঝে। এটাই ইন্ডাস্ট্রির কাছে আমার পাওয়া।

স্টুডিয়ো না স্টেজ, আপনার কোনটা পছন্দের?
আমার বাড়িতে ছোট একটা স্টুডিয়ো আছে। রেকর্ডিং ব্যাপারটাকেও খুব এনজয় করি। কিন্তু এখন তো সফটওয়্যারের যুগ। সফটওয়্যার দিয়ে অ-গায়কেরা গায়ক হয়। এটা খুব খারাপ ব্যাপার। তাই আমি মনে করি শিল্পীর আসল পরিচয় কিন্তু স্টেজেই পাওয়া যায়। যে কোনও ধরনের শ্রোতা নিয়ে আমি মঞ্চ কাঁপিয়ে তুলতে পারি। আমি বহু বার গ্রামের কলেজে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে ‘জিলে লে’-র দর্শককে শচীন কর্তার গান শুনিয়েছি। সেটা তাঁরা নিয়েওছেন। রিকশাওয়ালাকেও খেয়াল শুনিয়ে মুগ্ধ করেছিলাম।

নতুন প্রজন্মের শিল্পী হয়ে ওঠার পিছনে রিয়্যালিটি শো কতটা জরুরি?
রিয়্যালিটি শো শিল্পীর নিজেকে তৈরি করার পথে এক ধরনের উৎসাহ জোগাতে পারে। কিন্তু এখন রিয়্যালিটি শোয়ে গান গাওয়াই পারফর্মারদের জীবনের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। সেটা কিন্তু ক্ষতিকারক। এগুলো অভিজ্ঞতা হিসেবে নেওয়াই ভাল, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। সবাই ভাবছে সেজেগুজে কী ভাবে অন্যের গান গেয়ে নাম করব। কেউ ভাবছে না কেমন করে নিজের গান গাইব। মেয়েরা অধিকাংশই এখন শ্রেয়া হতে চায়। এই ব্যাপারটা খুব ক্ষতিকারক। দীর্ঘদিনের শিক্ষা ও চর্চার গুরুত্ব কমে আসছে।

এখন রাজনীতির স্টেজে গায়কদের দেখা যাচ্ছ। আপনি নেই কেন?
আমার কোনওদিন মনে হয় না রাজনীতির হাই প্রোফাইল মানুষের সঙ্গে যুক্ত থাকলে শিল্পী হিসেবে আমার সম্মান থাকবে বা বাড়বে। পশ্চিমবঙ্গে যে রঙই আসুক, রাজনীতিতে আমি কোনওদিন পা বাড়াব না। তাতে কাজ কম পাব। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না।

এ সব দেখে ফ্রাস্ট্রেশন হয় না?
না কখনওই না। আমি ধরেই নিয়েছি সারা জীবনে হয়তো পঁচিশটা সিনেমার জন্যে গান গাইব। লোকে জানবে একজন ভাল গায়ক ছিলেন, যিনি কেবলমাত্র পঁচিশটা অসাধারণ গান গেয়ে গিয়েছেন। আমি চিরকাল এটাই চেয়েছি। একগাদা ভুলভাল গান গেয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চাইনি আমি। আমি কোয়ালিটি মিউজিক করতে চাই। সব সময় মনে হয়, আমি নই, আমার কাজ কথা বলবে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.