|
|
|
|
অন্য মা |
গুজব ছড়িয়েছে যে শাহরুখ-গৌরী সারোগেসির হাত ধরে নিজেদের জীবনে নিয়ে আসছেন পরিবারের নতুন সদস্যকে।
এ দিকে আমির আর কিরণ তাঁদের দেড় বছরের আজাদের জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন পছন্দের প্লে-স্কুল। সমাজে
সারোগেসি নিয়ে যে ধোঁয়াশা রয়েছে, তা কি এ বার কাটবে? উত্তর খুঁজলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
কেস ১
ধুমধাম করে বরের জন্য বাইক কিনেছিলেন সারদাবেন।
বাইকের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ।
কৃষ্ণ কে?
চার বছর আগে নিজের গর্ভ ভাড়া দিয়েছিলেন সারদা। ছেলে হয়েছিল। নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ। এক মাস বয়সেই কৃষ্ণকে নিয়ে ওর বাবা-মা আমেরিকা চলে যান। সারদা থেকে যান গুজরাতের এক গ্রামে। স্মৃতি বলতে শুধু ছেলের একটা ফোটো। চলে যাওয়ার আগে বাচ্চাটার সঙ্গে তুলেছিলেন ছবিটা। জন্মদিনেও কোনও ফোন আসে না কৃষ্ণর কাছ থেকে। নিজের কাছে ওই আমেরিকান দম্পতির কোনও নাম্বারও নেই সারদার। তাই ফোন করা হয় না।
“সরোগেট মা হওয়ার পরে যা টাকা পেয়েছিলাম, তা দিয়ে নিজের স্বামীকে একটা বাইক কিনে দিয়েছিলাম। আর বাইকের উপর একটা স্টিকার দিয়ে নাম লিখে দিই, ‘কৃষ্ণ’। ছেলেটাকে তো আর দেখতে পাই না। বাইকে ওর নামটা দেখলে ভাল লাগে,” বলেন বছর পঁয়ত্রিশের সারদা।
চার বছর হল সরোগেট মায়ের ভূমিকায় কাজ করছেন তিনি। আরও দু’টি যমজ মেয়ের জন্ম দিয়েছেন এ ভাবেই। নাম রেখেছিলেন নিশা আর এষা। “আমার বেশ মনে আছে, চলে যাওয়ার আগে ওদের ওজন ছিল তিন কিলোগ্রাম। জানি না এখন কেমন দেখতে হয়েছে ওরা। বেশ ফরসা ছিল দু’জনই। কানাডাতে থাকে এখন,” সারদা জানান।
কৃষ্ণ, নিশা, এষার জন্য মন কেমন করে না তাঁর? “মায়ের মন, খারাপ তো লাগবেই। কিন্তু নিয়তি, সেটাকেও তো ভোলা যায় না। আমার নিজের তিনটি সন্তান। স্বামী তেমন ভাল আয় করতেন না। বড় মেয়েকে বোঝাই যে এ ভাবে নিজের গর্ভ ভাড়া দিলে আমাদের সংসারটা ভাল চলবে। ও বুঝতে পারে। নিজের ভাই-বোনদেরকেও বোঝায়। আমি অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন আমার স্বামী আমাদের বাচ্চাদের খুব খেয়াল রাখত। ও নিজে কৃষ্ণ, নিশা আর এষার জন্মদিনটাও মনে রেখে দিয়েছে। জন্ম তারিখে ও চকলেট এনে সবাইকে সেটা বিলিয়ে দেয়। ভগবানের কাছে পুজোও দেওয়া হয় ওই দিনগুলোতে।”
কেস ২
সারা বছর ধরে হংসাবেন দু’টো দিনের জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকেন। ওই দিনগুলোয় ওঁর জন্য ই-মেলে দু’টো ছবি আসে। তিন ছেলেমেয়ের ছবি। দু’জন থাকেন আমেরিকাতে। আর এক জন জাপানে। ২০০৭ সালে আমেরিকার এক ডাক্তার দম্পতি এসে হংসার গর্ভ ধার নেন। “আড়াই মাস বয়সে দুই ছেলেকে নিয়ে চলে যায় ওরা। একটু চোখে জল এসেছিল ঠিকই। তবে আমি তো জানতাম ওরা ওদের নিজের বাবা-মায়ের কাছে চলে যাচ্ছে। তাই কান্নায় ভেঙে পড়িনি। ওদের নাম আজও মনে আছে নোভা অ্যান্থনি আর ফেইথ সামিয়া,” হংসা বলেন। জাপান থেকে ২০১০ সালে আর এক দম্পতি আসেন হংসার কাছে। “মেয়ে হয়েছিল। নাম দিয়েছিল স্বরূপা। দেড় মাস পরে মেয়েকে নিয়ে চলে যায় ওরা। এখন শুধু ই-মেলে ওদের ছবির অপেক্ষায় থাকি। আমার নিজের একটা কুড়ি বছর বয়সের ছেলে আছে। মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার সময় ও একটু কান্নাকাটি করেছিল। বলত ভাইদের নিয়ে গেলে ঠিক আছে। বোনকে যেন রেখে যায়। কিন্তু তা কি আর হয় নাকি? ওকে বুঝিয়েছিলাম পুরো বিষয়টাই,” বলেন হংসা। |
খান দম্পতি। সত্যিই কি নতুন সদস্য আসতে চলেছে তাঁদের সংসারে? |
সারদা আর হংসা দু’জনেই জানেন আমির খান আর কিরণ রাওয়ের সরোগেট বাচ্চার কথা। শাহরুখ খান আর গৌরীকে ঘিরে যে সরোগেসির গুজবটা ছড়িয়েছে, হংসা সেটাও জানেন। এমনটাও শুনেছেন যে দুই সন্তানের মা হওয়া সত্তেও গৌরীই প্রথম সারোগেসির ব্যাপারে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যদিও এ ব্যাপারে এখনও নির্দিষ্ট ভাবে কিছু জানা যায়নি। তাও সারদা আর হংসা দু’জনেরই মত যে আমাদের দেশের তারকারা এ ধরনের কিছু করে সে বিষয়ে কথা বললে তাতে সমাজের অনেক উপকার হবে।
তবে এমনটা মনে করছেন না কলকাতার সঞ্জীবকুমার (নাম পরিবর্তিত)। সঞ্জীব আর তাঁর স্ত্রীর এগারো বছরের একটি মেয়ে আছে। কিন্তু সঞ্জীব নিজে একমাত্র সন্তান। তিনি চাননি যে তাঁর মেয়েও একমাত্র সন্তান হয়ে বেড়ে উঠুক। কলকাতার কোনও ডাক্তার বাদ ছিল না যাঁকে এই দম্পতি দেখাননি। শেষে ইন্টারনেটে খোঁজ পান গুজরাতের ডাক্তার নয়না পটেলের ক্লিনিকের। “ওখানে যাওয়ার পর আমাদের পুরো বিষয়টা সম্পর্কে বোঝানো হয়। আমার স্ত্রী ঠিক করেন যে আমরা গর্ভ ধার নেব। আমার বাবা ছাড়া আর কেউ জানতেন না যে আমরা সরোগেসি ব্যবহার করছি,” সঞ্জীব জানান।
আর তার পর শুরু হয় এক মজার খেলা। সঞ্জীবের স্ত্রী ঠিক করেন যে তিনি নয় মাস ধরে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার অভিনয় করবেন। “আমাদের সমাজ এখনও এত উদার হয়নি যে সরোগেসিকে মুক্ত মনে গ্রহণ করবে। তা ছাড়াও আমাদের বড় মেয়ের বয়স তখন বেশ অল্প। ও তো ম্যাচিওরড নয়। তাই ঠিক করলাম অভিনয় করব। শুধু একটু খেয়াল রাখতে হল যাতে কেউ পেটে হাত না দেয়,” সঞ্জীবের স্ত্রী জানান।
সঞ্জীব নিজে মাঝেমধ্যেই সারোগেট মায়ের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে আসতেন। “খুব গরিব ঘরের মহিলা তিনি। নিজের দু’টি বাচ্চা ছিল। আমরা ওর স্বামীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। মাঝে মধ্যে গিয়ে ফল, ড্রাই ফ্রুটস দিয়ে আসতাম। আমার স্ত্রীর সঙ্গে তো নিয়মিত ফোনে কথা হত ওদের। আর সব থেকে বড় ব্যাপার হল আমরা হিন্দু। কিন্তু ওই সারোগেট মহিলা হলেন মুসলিম। আমাদের এ নিয়ে কোনও আপত্তি ছিল না। রক্তের রং তো দুই ধর্মেরই এক,” বলছেন সঞ্জীব।
প্রসবের ঠিক এক মাস আগে দু’জনেই চলে যান অমদাবাদ। “টাকা দিয়ে কোনও দিন আমরা ওই সারোগেট মায়ের মূল্য দিতে পারব না। আজ আমাদের বাড়িতে তিনটি ছেলেমেয়ে। সারোগেসি দিয়ে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে হয়েছে,” জানান সঞ্জীব। ফেসবুকে বাচ্চাদের ছবি পাঠিয়ে দেন।
কিন্তু বাড়িতে কোনও দিন জানাবেন না সারোগেসির গল্প? “যখন বুঝব যে ম্যাচিওরিটি এসেছে তখন নিশ্চয়ই সব জানিয়ে দেব। তবে আমাদের সমাজ পাল্টাতে সময় লাগবে। আমির খান তো সেলিব্রিটি। তিনি কী করছেন, তা শুনে কি আমাদের পাড়ার লোকের ধারণা রাতারাতি পাল্টে যাবে?” প্রশ্ন এই দম্পতির।
ডা. গৌতম খাস্তগীর বলছেন যে গুজরাতের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে এখনও সারোগেসি নিয়ে সচেতনতা কম। তাঁর মতে এখনও অনেকে সারোগেসিকে ভুল করে বেশ্যাবৃত্তির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। বলা হয় এটা নাকি শরীর বিক্রি করার উপায়। এতে যে এক জন নিঃসন্তান দম্পতির কত উপকার হতে পারে তা ভেবে দেখা হয় না। “অবশ্য সারোগেসি নিয়ে বিদেশেও অনেক ধোঁয়াশা রয়েছে। জার্মানি, স্পেন, ইতালি এই সব দেশে সারোগেসি এখনও বেআইনি। কারণ ওখানে রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রভাবটা বেশি। আর এই চার্চ সারোগেসিকে স্বীকার করে না, সম্মতি দেয় না। কিন্তু ইউনাইটেড কিংডমে সারোগেসি সম্ভব। কারণ ইংল্যান্ডের চার্চের সারোগেসিতে সম্মতি আছে। ওখানকার হিউম্যান ফার্টিলাইজেশন এমব্রায়োলজি অথারিটি নিয়ম করে দিয়েছে যে সারোগেসি করে কেউ আর্থিক লাভ নিতে পারবেন না। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মা, সৎমা, বোন, দূর সম্পর্কের বোন, বা প্রতিবেশীরাই সারোগেট মাদার হয়ে থাকেন। অস্ট্রেলিয়াতে কিছু কিছু স্টেটে সরোগেসি নিষিদ্ধ। আমেরিকা অবশ্য অনেক বেশি মুক্তমনা। এজেন্সিদের সারোগেসি নিয়ে ক্যাটালগও রয়েছে যা দেখে দম্পতিরা বেছে নিতে পারেন!” বললেন ডা. গৌতম খাস্তগীর। |
|
ছেলে আজাদের সঙ্গে কিরণ এবং আমির |
তিনি আরও বলছেন যে কলকাতাতে অনেকেই সারোগেসি সম্পর্কে খুব একটা জানেন না। “অনেকেই জেস্টেশনাল সারোগেসি (পুরুষের শুক্রাণু আর তার স্ত্রীর ডিম্বাণু ব্যবহার করার পদ্ধতি) আর ন্যাচেরাল সারোগেসি (যেখানে সারোগেট মায়ের ডিম্বাণু আর সন্তানেচ্ছু দম্পতির স্বামীর শুক্রাণু ব্যবহার করার পদ্ধতি) মধ্যে পার্থক্যটা জানেন না। অনেক ক্ষেত্রে এটাই দেখা গেছে যে সারোগেট মা, দম্পতিকে গর্ভাবস্থার মাঝখানে ব্ল্যাকমেল করছে এই বলে যে টাকা না বাড়ালে সে গর্ভপাত করিয়ে ফেলবে।
তাই আজকাল সারোগেসিতে দুই ভাগে পেমেন্ট করা হয়। তবে সব থেকে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা। শুধুমাত্র এটা ভাবলে চলবে না যে সরোগেসি তো তারকারাই করে থাকেন, সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে সেটা। আইভিএফ করার খরচা পড়ে আশি হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা। অনেকেই আবার কোনও টাকা না নিয়েই গর্ভধারণ করতে রাজি থাকেন। তাই এই রকম ক্ষেত্রে সরোগেসি খুব একটা খরচসাপেক্ষ নয়,” জানাচ্ছেন ডা. খাস্তগীর।
আর এ বিষয়ে ডাক্তার নয়না পটেলের কথা বারবার করে বলছেন তিনি। ওপরা উইনফ্রের শোতেও গিয়েছিলেন নয়না। নিজের ক্লিনিক চালান আমদাবাদে। যেখানে সরোগেট মায়েদের প্রসবের পরেও দেখাশুনো করা হয়। তাঁদের পুরো পরিবারের খেয়াল রাখেন নয়নার ট্রাস্ট। বাচ্চাদের স্কলারশিপও দিয়ে থাকেন। বলছেন, “ওপরার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে ও প্রথমেই বলেছিল: ‘আ উম্যান হেল্পিং আ উম্যান, আই লাভ ইট!’ আমার কিন্তু মনে হয় তারকাদের সরোগেসি ব্যবহার করার গল্প হয়তো অনেককেই অনুপ্রেরণা দেবে। আমিরের ঘটনাটা আগেই শুনেছি। এ বার শাহরুখকে নিয়ে গুজবটা শুনছি। আমি জানি না শাহরুখ-গৌরীর গুজবের সোর্সটা কী। তবে এটুকু বলতে পারি যে সেলিব্রিটিরা যখন এ বিষয়ে শিরোনামে আসেন তখন সমাজের উপকার হয়। গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। আর সেটাই তো অনেক।”
কৃষ্ণ, নিশা, এষারা হয়তো
আমির, কিরণ বা আজাদের নাম শোনেনি। কিন্তু এ দেশে তাদের তারকাদের সারোগেসির পদ্ধতি অবলম্বন করাটা নিঃসন্দেহে সারোগেট মায়েদের কাছে একটা অন্য মাত্রা আনে। গোপনীয়তার আড়াল থেকে সরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। সমাজে মাথা উঁচু করে চলার সাহসটা দেয়। আর সঞ্জীবদের মতো অনেক দম্পতিকেই হয়তো বা বিশ্বাস জোগায় যে সরোগেসির সময় পেটে বালিশ বেঁধে মিথ্যের আশ্রয় নেওয়ার দিন বোধহয় শেষ।
|
সেলেব দুনিয়ায় |
• সারা জেসিকা পার্কার ও ম্যাথু ব্রডরিক
২০০৯-এ ‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি’ স্টার সারা আর তাঁর স্বামী সারোগেসির মাধ্যমে যমজ সন্তানের অভিভাবক হন।
• নিকোল কিডম্যান ও কেথ আরবান
২০১০-এর ডিসেম্বরে সারোগেসির মাধ্যমে জন্ম হয় তাঁদের সন্তান ফেইথ মার্গারেট কিডম্যান আরবানের।
• ম্যাইকেল জ্যাকসন
‘কিং অব পপ’য়ের পুত্র প্রিন্স ম্যাইকেল জ্যাকসন দ্য সেকেন্ড-এর জন্মও সারোগেসির মাধ্যমে। শোনা যায় তাঁর মা মেক্সিকান নার্স হেলেনা।
• এলটন জন ও ডেভিড ফারনিশ
সারোগেসির সহায়তায় ২০১০-এর ডিসেম্বরে ছেলে জ্যাকারি জ্যাকসন লেভন ফারনিশ-জনের জন্ম হয়।
• রিকি মার্টিন
২০০৮-এ ভ্যালেন্টিনো ও ম্যাটিও-র ‘সিঙ্গল ফাদার’ হন সারোগেসির মাধ্যমেই। সারোগেট মায়ের নাম অবশ্য অপ্রকাশিতই থেকেছে। |
|
|
ডা. গৌতম খাস্তগীর
আইভিএফ করার খরচা পড়ে আশি হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা।
অনেকেই আবার
কোনও টাকা না নিয়েই গর্ভধারণ করতে রাজি থাকেন।
তাই এই রকম ক্ষেত্রে সরোগেসি খুব একটা খরচসাপেক্ষ নয় |
|
|
|
|
|
|