লোবায় গুলি, সংঘর্ষে মৃত্যু দিনহাটাতেও
তিন দফায় ঘোষিত পঞ্চায়েত নির্বাচন শেষমেশ হবে কি না, সেটাই অনিশ্চিত। অথচ মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে।
বীরভূমের মতো কিছু জেলায় দ্বিতীয় দফায় মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল শনিবার। উত্তরবঙ্গে তৃতীয় দফার ভোটে সেই প্রক্রিয়া এখনও চলছে। এরই মধ্যে এলাকা দখলের লড়াইয়ে দু’জন খুন হলেন। বীরভূমের লোবা আর কোচবিহারের দিনহাটায়। মনোনয়ন শুরু হওয়া ইস্তক রাজ্যে এই নিয়ে অন্তত পাঁচ জন খুন হলেন। বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দিতে না দেওয়ার পরামর্শ দলের কর্মীদের দিয়েছিলেন যিনি, লোবার হামলাতেও সেই তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের নামই জড়িয়েছে।
রাজ্যে পালাবদলের পরে দুবরাজপুরের লোবায় তৃণমূল গোড়ায় কিছুটা দলভারী হলেও, পরে জমি আন্দোলনের ধাক্কায় তারা অনেকটাই জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। বরং সিপিএমের প্রভাব রয়েছে বেশ কিছু গ্রামে। এ দিন বিকেলে লোবা পঞ্চায়েতে মেটে নামে এমনই একটি গ্রামে তৃণমূলের শ’দুই দুষ্কৃতী চড়াও হয় বলে অভিযোগ। ঘরদোর লুঠপাট, বোমাবাজি হয়। প্রতিবেশীদের আশ্রয় দিতে গিয়ে মাথায় গুলি খেয়ে বাড়িতেই মারা যান ভাস্কর মজুমদার (৫৫) নামে এক নিরীহ গ্রামবাসী।
এ দিন সকাল থেকেই মনোনয়ন প্রত্যাহারের করানোর জন্য তৃণমূলের বাইক-বাহিনী দিনহাটায় বাম প্রার্থীদের হুমকি দিচ্ছিল বলে অভিযোগ। বুড়িরহাট ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের খট্টিমারি এলাকায় সিপিএম পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়িতেও হুমকি দেওয়া হয়। বিকেলে ফের বাইক-বাহিনী গ্রামে গেলে দু’পক্ষে সংঘর্ষ বাধে। জখম হন উভয় পক্ষের অন্তত ১৫ জন। মাথায় লাঠির বাড়ি খেয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় রতন বর্মন (৩২) নামে এক তৃণমূল কর্মীর। সিপিএমের তিন জন ও তৃণমূলের চার জন হাসপাতালে ভর্তি।
নিহত ভাস্করবাবুর দেহ ঘিরে কান্নায় ভেঙে পড়েছে পরিবার।
লোবায় ঘটনার সূত্রপাত বিকেল ৪টে নাগাদ। মেটের বাসিন্দা পরিমল ডোম, ধরণী ডোম, নন্দিনী দাস, জিতেন দাসদের অভিযোগ, “শ’দুয়েক সশস্ত্র তৃণমূলকর্মী নির্বিচারে বাড়িতে ঢুকে লুঠপাট শুরু করে। সামনে যাকে পেয়েছে, তাকেই মেরেছে। বাদ যাননি মহিলারাও। সম্মান বাঁচাতে ছুটে বেড়িয়েছেন।” তাঁরা জানান, ভাস্করবাবুর বাড়িতে কয়েক জন আশ্রয় নেন। দুষ্কৃতীরা সেখানে চড়াও হয়। আশ্রয় নেওয়া প্রতিবেশী মিহির দাস বলেন, “দরজার বাইরে থেকে ওরা জিজ্ঞাসা করে, ‘বাড়িতে কেউ ঢুকেছে?’ দাদা বলে দেন, ‘কেউ আসেনি। সবাই বাড়ির লোক।’ দুষ্কৃতীরা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে গুলি চালায়। আমাদের চোখের সামনেই দাদা লুটিয়ে পড়েন।”
সন্ধ্যার মুখে গ্রামে পৌঁছে দেখা যায়, পুলিশ তখনও আসেনি। বহু বাড়িতে লুঠপাটের চিহ্ন স্পষ্ট। মহিলাদের কান্নার রোল। ভাস্করবাবুর বাড়ির গ্রিলের দরজার সামনে রক্তের ধারা। ভেতরে নিথর দেহ ঘিরে ভিড়। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ গ্রামে পুলিশ ঢুকতেই গ্রামবাসীরা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। লোবা গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিএম প্রার্থী অনিল বাগদির অভিযোগ, “আক্রমণ শুরু হতেই পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ এসে গ্রাম থেকে সামান্য দূরে তরুলিয়া মোড়ে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকে।” পুলিশ অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
সিপিএমের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “তৃণমূল পরিকল্পিত ভাবে হামলা চালিয়েছে। কার কার নেতৃত্বে এই হামলা হয়েছে, সেই খোঁজ নিয়ে আমরা পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করতে চলেছি।” সরাসরি তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের গোষ্ঠীর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন গ্রামবাসী। অনুব্রতবাবুর ফোন বন্ধ ছিল। তৃণমূলের জেলা চেয়ারম্যান আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, “যে কোনও ঘটনাতেই এখন তৃণমূলকে দায়ী করা হচ্ছে।” আজ, রবিবার ১২ ঘণ্টা দুবরাজপুর বন্ধের ডাক দিয়েছে বামফ্রন্ট।
তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নির্দেশে রাতেই দিনহাটায় পৌঁছন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। তিনি জানান, আজই তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দিনহাটা যাওয়ার কথা। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক উদয়ন গুহের প্রত্যক্ষ মদতে আমাদের মিছিলের উপরে হামলা চালানো হয়েছে।” উদয়নবাবু পাল্টা বলেন, “ওই ঘটনা যখন ঘটে, আমি কলকাতার ট্রেনে ছিলাম। বাইক বাহিনীর দৌরাত্ম্যের কথা অন্তত বিশ বার পুলিশকে জানিয়েছি।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মুদির দোকানি রতনবাবু গত বার তৃণমূলের হয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতে দাঁড়িয়ে হেরেছিলেন। এ বার তাঁর এক আত্মীয়া ওই আসনে দাঁড়িয়েছেন। কোচবিহার জেলা তৃণমূল সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “আমাদের সমর্থকেরা প্রচারে যাওয়ার সময় পাট খেতে লুকিয়ে থাকা সিপিএম ও ফরওয়ার্ড ব্লক দুষ্কৃতীরা পরিকল্পিতভাবে হামলা চালায়।” তবে সিপিএমের দিনহাটা জোনাল সম্পাদক তারাপদ বর্মনের দাবি, “সকাল থেকে তৃণমূলের বাইক বাহিনী ওই সব গ্রামে সন্ত্রাস শুরু করে।”
কোচবিহার জেলা সদর হাসপাতালে সংঘর্ষে জখম তৃণমূলকর্মী।
এ দিন দুবরাজপুরেই সিপিএমের এক মহিলা প্রার্থীর বাড়ির উঠোন থেকে আটটি তাজা বোমা উদ্ধার হয়। সিপিএমের দাবি, তৃণমূলই ওই বোমা রেখেছিল। মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জে সুতি-২ নম্বর ব্লকের বালিয়াঘাটা গ্রামে সিপিএমের এক পঞ্চায়েত প্রার্থীর বাড়ি থেকে ১০৫টি তাজা বোমা উদ্ধার হয়েছে। ওয়াসিম বারি নামে ওই প্রার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুপুরে উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ায় ঘাসখালির এক তৃণমূল কর্মীকে দা দিয়ে কোপানোর অভিযোগ ওঠে সিপিএমের বিরুদ্ধে। তিন জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
শুক্রবার রাতে ভাঙড়ের মাধবপুরে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষে আহত হন উভয় পক্ষের ছ’জন। পুলিশ ছ’জনকে ধরেছে। ওই রাতেই হুগলির তারকেশ্বরে মোহনবাটিতে সিপিএমের জোনাল সম্পাদকের বাড়িতে ইট ছুড়ে জানলার কাচ ভাঙায় অভিযুক্ত তৃণমূল। চণ্ডীতলার ভগবতীপুরে আবার তৃণমূলের দলীয় কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে সিপিএমের বিরুদ্ধে।
এ দিকে, অভিযুক্ত তৃণমূল কর্মীদের পুলিশ গ্রেফতার না করায় শনিবারও জলপাইগুড়িতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক অবরোধ হয়। গত বৃহস্পতিবার জেলা কংগ্রেস সভাপতি মোহন বসুর উপর তৃণমূল হামলা চালায় বলে অভিযোগ ওঠে। আক্রান্ত মোহনবাবু জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালে ভর্তি। আগামী বুধবার ১২ ঘণ্টা জলপাইগুড়ি জেলা বন্ধের ডাক দিয়েছে কংগ্রেস।

(সহ-প্রতিবেদন: সামসুল হুদা, প্রকাশ পাল, নির্মল বসু, বিমান হাজরা, অনির্বাণ রায়, অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়)

—নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.