আফ্রিকার উগান্ডার কানুনগু জেলায় বাকিগা উপজাতিদের গ্রামে এসেছি। বুইন্ডির বিরাট পাহাড়ি জঙ্গলের গায়েই এই গ্রাম। বুইন্ডির গভীর জঙ্গলে পাহাড়ি গরিলাদের দেখা পাওয়া যায়। গ্রামে রাতটা কাটিয়ে পর দিন সকালে যাব সামনের ওই ঘন পাহাড়ি জঙ্গলে।
এ দিকে ভোর থেকে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। সকাল আটটা নাগাদ বৃষ্টিটা একটু ধরতে রেনকোটে গা-মাথা ঢেকে জিপে চড়ে বনের দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলাম। এর পর জিপ আর যাবে না। জিপ থেকে নেমে সবে জঙ্গলে ঢুকছি, হঠাৎ কানে এল কোত্থেকে একটা পাখি ডেকে চলেছে উগান্ডা ইবোনিরে। উগান্ডা ইবোনিরে।
পাখিটা কথা বলছে বাকিগা উপজাতির রুকিগা ভাষায়। আমি যে এলাকায় আছি, সেখানকার লোকেরা এই ভাষাতেই কথা বলে। ‘উগান্ডা ইবোনিরে’ কথাটার মানে কী জানো? উগান্ডা খুব সুন্দর।
পাখিটা বার বার একই কথা বলে যাচ্ছে। তার মধ্যেই আর একটি পাখি গেয়ে উঠল নিতিকুন্ডা ইহা আম্বা রিয়া উগান্ডা।
অর্থাৎ, আমরা উগান্ডার জঙ্গল ভালবাসি।
পাখিরা তো বেশ নিজেদের দেশ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে! আরও একটা জিনিস লক্ষ করলাম। এখানকার পাখিরা দুটো-একটা শব্দ বার বার না বলে, সুর করে গোটা গোটা বাক্য বলে। শোনায়ও ভারী মিষ্টি। যেন পিয়ানো বাজছে। কথার মধ্যে টুংটাং, ডিংডং,
ইন্ডাউন্ডা, আম্বা, ওকুবোনাবোনা, আহা বানতু-বা শুনতে শুনতে মনে হয় এখানকার মানুষের ভাষা প্রথমে পাখিদের ভাষাই ছিল না তো? হয়তো অনেক কাল আগে বনের পাখিদের ভাষা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর শুনতে শুনতে পাখিদের ঠোঁট থেকে মানুষই শিখে নিয়েছে। অনেকে যেমন শুধু শুনে শুনেই আস্ত আস্ত এক একটা গান শিখে ফেলে!
এর মধ্যে অদ্ভুত একটা কাণ্ড দেখে আমি তো অবাক। একদল পাখি চার দিক থেকে ডানা ঝটপট করতে করতে উড়ে এসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল তোমাদের জন্য বাংলা করে দিলাম উগান্ডার গুন্ডাপাখি, আবার এলি কোত্থেকে? বনের যত কচিপাতা ঠুকরে ছিঁড়ে করিস যা-তা! যা ভাগ পালা, এক্ষুনি ছাড় জঙ্গল।
শুনেই আগের পাখিটার সুরে গলা মিলিয়ে অনেক পাখি একসঙ্গে গেয়ে উঠল নিতিকুন্ডা ইহা আম্বা রিয়া উগান্ডা (আমরা উগান্ডার জঙ্গল ভালবাসি)!
কোন পাখিটাকে এরা ‘উগান্ডার গুন্ডা’ বলে বন থেকে তাড়াতে চাইছে, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে আমি একটা পাখিকে দেখছি এক বার এ-ডালে এক বার ও-ডালে লাফ মারার মতো গিয়ে ধপাস করে বসেই লম্বা বাঁকা ঠোঁট আর বড় বড় নখ দিয়ে গাছের কচি কচি ডগাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে নীচে ফেলে দিচ্ছে। অনেকটা দাঁড়কাকের মতো চেহারা, রং-ও কাকের মতো, ঠোঁটটা ঈগলের মতো একটু বড় ও বাঁকানো। ডাকটা কাকের ডাক মাইকে যেমন শোনাবে, ঠিক তেমনই। |
পরের মুহূর্তেই দেখলাম দাঁড়কাকের মতো পাখিটার কাছাকাছি যেখানে যত কচি কচি ডালপালা আছে সবগুলোর ওপর এক ঝাঁক একই রকম চেহারার পাখি উড়ে এসে ডানা গুটিয়ে ঝপঝপ করে চেপে বসল। এরাই তা হলে সেই গুন্ডাপাখির দল!
ঠিক তা-ই। কেননা, বুইন্ডি বনের পাখিরাও সবাই দল বেঁধে তাদের তাড়াতে এল। একটা যুদ্ধ লাগার মতো অবস্থা।
গুন্ডাপাখির দলের চেয়ে এই বনের পাখিরা সংখ্যায় অনেক বেশি দেখে, সবচেয়ে বড় ঠোঁটের একটা পাখি, সে-ই বোধ হয় গুন্ডাদলের সর্দার, বনের পাখিদের সামনে এসে মনে হয় যুদ্ধ যাতে না লাগে তার জন্য কিছু বলতে চাইছে। নিজের দলের সকলের ডাক থামিয়ে সর্দার পাখি যা বলল সেটা যে কত সত্যি, তা আমি নিজেও জানি। তার সব কথা লিখতে গেলে অনেক বড় হয়ে যাবে। মূল কথাটা হল, এরা সব ব্রাজিলের আমাজনের জঙ্গলের পাখি। শত শত বছর ধরে সেখানে তাদের বাসা ছিল। সেই জঙ্গলের অনেকটাই এখন কাটা পড়েছে। আমাজনের রেনফরেস্টের মায়া ছেড়ে নানা দেশে খুঁজতে খুঁজতে আফ্রিকার উগান্ডায় এই বুইন্ডি রেনফরেস্ট পেয়ে তারা এখানে থাকতে চায়। কিন্তু এখানে সবাই তাদের দেখলেই দূর দূর করে। তাই তাদের দলের কেউ কেউ রাগে, হিংসায়, মনের জ্বালায় বনের সব কচি কচি ডগা ভেঙে ছিঁড়ে ফেলে দেয়।
আমাজনের জঙ্গল কাটার জন্য হেলিকপ্টারে চড়ে সাহেবরা আকাশ থেকে জঙ্গলের ফটো তুলছে, এ আমি নিজের চোখে দেখেছি। জঙ্গলের ফটো তুলে সেই মতো ম্যাপ বানিয়ে জঙ্গল কাটাই তাদের উদ্দেশ্য। তখন আমি বেশ ছোট, আমার রিও-ডি-জেনেরোর কাকার সঙ্গে আমাজনের জঙ্গলে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম।
আমাজনের পাখিটার সব কথা শুনে বুইন্ডি বনের পাখিদের দলপতি ছন্দে-সুরে ছড়া পড়ার মতো একটানা বলে গেল হারহো ওকুবোনাবোনা আহা বানতু-বা এনসি ইওনা (দুঃখকষ্ট সারা পৃথিবীতেই আছে)। তাই বলে আমরা অন্যের বন নষ্ট করে বেড়াব?
বনের অন্য পাখিরাও আবার একসঙ্গে বলে উঠল নিতিকুন্ডা ইহা আম্বা রিয়া উগান্ডা (উগান্ডার অরণ্য আমরা ভালবাসি)। তোমরাও ভালবাসলে আমাদের সঙ্গেই এই বনে থাকতে পারো।
তখন দু’দল পাখির গলায় যে কী রকম আনন্দের বান ডাকল কিছুতেই সেটা লিখে বোঝানো যাবে না। যত ক্ষণ না আমি বুইন্ডির গভীর জঙ্গলে গরিলার খোঁজে অনেক দূরে চলে গেছি তত ক্ষণ তাদের নানা সুরের নানা তালের ডাকাডাকি শুনতে পেলাম।
তার পরেও আরও প্রায় তিন ঘণ্টা জঙ্গলের মধ্যে এ-দিক ও-দিক খুঁজতে খুঁজতে প্রথম যে গরিলার দেখা পেলাম, সেটা এমনই আচমকা যে আমার হাত থেকে ক্যামেরা বনের ঝরা পাতার পচা স্তূপের মধ্যে পড়ে গেল।
গরিলাদের আস্তানায় আমার জন্য আরও একটা চমক বাকি ছিল! বৃষ্টিভেজা জামাকাপড়ে, জুতো-ভর্তি জলকাদা নিয়ে অনেক কষ্ট করে যখন ক্যামেরাটা তোলার চেষ্টা করছি, তখন একটি শিশু-গরিলা এসে ক্যামেরাটা আমার হাতে তুলে দিল। তুলে দিয়েই যেমন এসেছিল তেমনই চলে গেল। তখনই চোখে পড়ল তার পিঠে একটা লাল-কালো রঙের বড় পাখি। পরে যত গরিলা দেখলাম, শিশু-গরিলারা সব সময়ই মায়ের পিঠে চড়ে চলেছে। কিন্তু এই শিশু-গরিলার পিঠে কেন পাখি? বন থেকে বেরিয়ে গাইডকে জিজ্ঞেস করে যা জানলাম সেও একটা দারুণ গল্প। গত বছর ভয়ানক বর্ষায় জঙ্গলে বিরাট একটা বাজ পড়ে শিশু-গরিলার মা মারা যায়। সেই থেকে এই পাখিটাই তাকে রোজ বনের কচিপাতা এনে খাইয়ে বড় করে তোলে। এমনিতে পাখিটার নিজের খাদ্য পিঁপড়ে থেকে উইপোকা, মরা ইঁদুর সব কিছু। কিন্তু গরিলা-শিশুর জন্য এনে দিত তার প্রিয় কচিপাতা। সেই ছোট্ট গরিলা এখন নিজেই বনের লতাপাতা খেতে পারে, কিন্তু এখনও তারা এক জন আর এক জনকে ছাড়া থাকতে পারে না। |