বিষ্ণুপুর যেমন বিখ্যাত বালুচরীর জন্য, তেমনই সোনামুখীর সিল্ক আর তসরের খ্যাতি। কিন্তু তাঁতিদের ঘর আলো হয় কই?
দীর্ঘ দিন ধরেই তাঁতিদের একটা বড় অংশ মূলধনের জন্য মহাজনদের উপরে নির্ভরশীল। সেই চক্র ভাঙতে সমবায় ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে সরকার। কিন্তু সব তাঁতি তার আওতায় আসেননি।
এর বাইরে এখন এসেছে বুটিক বা নতুন ধারায় অভিনবত্বের চিন্তা। গতানুগতিক একরঙা তসর এখন আর অনেকেরই মন টানে না। তাই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছেন ফ্যাশন ডিজাইনারেরা। তাঁদের ব্যবসা এবং বিপণনের কায়দাও অন্য রকম। এঁদের উপস্থিতি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
তসরের শাড়ি বানানো এক কথায় কষ্টসাধ্য কাজ। প্রথমে কাঁচা রেশম বিশেষ পদ্ধতিতে কেচে রোদে শুকিয়ে সুতো তৈরি হয়। কিন্তু তাতে জট থাকে। সাধারণত তাঁতিবাড়ির মেয়েরা হাজার-হাজার সুতোর প্রতিটি খুঁটিয়ে দেখে নিপুণ হাতে জট ছাড়ান। অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ, প্রাকৃতিক আলো-হাওয়া নির্ভর সেই কাজ।
সুতো তৈরির পরে তা তাঁতে আড়াআড়ি করে লাগানোর জন্য বিছিয়ে ফেলা হয়, যাকে বলে ‘টানা’। টানাতেও জট থাকে। সেই জটও ছাড়াতে হয়। টানা তাঁতে জোড়ার পরে তার উপরে লম্বালম্বি যে সুতো ফেলা হয়, তাকে বলে ‘পোড়েন’। দিনভর এই টানা-পোড়েন নিয়েই তাঁত বুনে শাড়ি তৈরি করেন তাঁতি। পুরুষদের সঙ্গে নিরন্তর কাজ করে চলেন বাড়ির মেয়েরাও। এমনই একজন মায়ারানি সুর। ১০ বছর বয়স থেকে এই কাজ করে চলেছেন। এখন বয়স ৬৫। বসে-বসে দীর্ঘদিন কাজ করতে করতে কুঁজো হয়ে গিয়েছেন। সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না।
সোনামুখীর তাঁতিরা জানাচ্ছেন, হালফিল এক কেজি টানার দাম ৩৬৫০ টাকা। বাজার থেকে কেনা আনা সুতো বোনার উপযোগী করে তুলতে গিয়েই কেজিতে ২৫০ গ্রাম নষ্ট হয়। অতএব ৭৫০ গ্রাম টানার দাম পড়ে ৩৬৫০ টাকা। পোড়েনের দাম কেজিতে ২০০০ টাকা। শাড়িতে রেশম লাগে গড়ে ২৮০ গ্রাম। একটি টানায় গড়ে ২৮টি শাড়ি হয়। তাতে লাভ থাকে গড়ে সাড়ে তিনশো থেকে চারশো টাকা। সারা মাসে এক জন তাঁতি গড়ে আট থেকে দশটি শাড়ি বুনতে পারেন। |
সোনামুখীতে চলছে চরকায় সুতো কাটার কাজ। ছবিঃ বিকাশ মশান। |
রেশম ও অন্য কাঁচামাল কেনার আর্থিক সামর্থ্য কিন্তু বেশির ভাগ চাষিরই নেই। দূরদূরান্ত থেকে কাঁচা রেশম নিয়ে আসার মতো সময়ও হাতে থাকে না। শাড়ি তৈরি হওয়ার পরে তা বিক্রি করার ব্যবস্থাও তাঁতির করায়ত্ত নয়। সমবায় অথবা মহাজনের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া গতি নেই।
সোনামুখীর কার্তিক আউথ, বাবুল কর, শম্ভুনাথ সুররা মহাজনের মাধ্যমে কারবার করেন। মহাজনেরাই তাঁদের কাঁচামাল জোগান দেন। তৈরি শাড়ি কিনেও নেন। সেই শাড়ি চড়া দামে বাজারে বিক্রি হয়, কিন্তু তাঁতির ঘরে আসে সামান্য। এক বার টানা শেষ হলে নতুন টানা জুড়তে বেশ কয়েক দিন লাগে। উৎপাদন শূন্য হয়ে যায়। তাঁতির হাতে আর টাকা আসে না। সেই সময়ে তাঁদের অবস্থা অনেকটাই ‘দিন আনি দিন খাই’ মজুরদের মতো। তাঁতিদের কথায়, “ব্যাঙ্কের ঋণ পেলে নিজেরাই কাঁচামাল কিনে শাড়ি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতে পারি। তাতে আমাদের লাভ বাড়ে, ক্রেতাও কিছুটা সস্তায় পেতে পারেন।”
রাজ্য সরকারের হ্যান্ডলুম দফতর সূত্রের খবর, তাঁতিদের মহাজনদের হাত থেকে বাঁচাতেই সরকার সমবায় সমিতি গড়েছে। তারা কাঁচামালের জোগান দেয়। শাড়ি তৈরির পরে তা কিনে সরকারেরই হ্যান্ডলুম বিপণন সংস্থাকে বিক্রি করে। সমবায় সমিতির সঙ্গে যুক্ত তাঁতিরা স্বনির্ভর গোষ্ঠী হিসাবে শাড়ি বোনেন। শাড়ি পিছু সব মিলিয়ে গড়ে প্রত্যেকে ৩৫০ টাকা লাভ পান। এ ছাড়া, সন্তান নবম শ্রেণিতে ওঠার পরে তাঁতিরা বছরে ১২০০ টাকা করে পান। থাকে মেডিক্লেমের ব্যবস্থাও।
কিন্তু সব তাঁতি সমবায় সমিতিতে যুক্ত নন। কারণ সমিতিতে কত সদস্য থাকবেন তা নির্দিষ্ট। সেই সংখ্যাটা যথেষ্ট নয়। আবার সমিতির কাজকর্ম নিয়েও অসন্তুষ্ট অনেক তাঁতি। তাঁদের অভিযোগ, সমিতির কর্মকর্তারা পছন্দের তাঁতিদের তালিকায় ঢুকিয়ে নেন। সমবায় সমিতিতে যাঁরা যুক্ত নন, তাঁদের নিয়ে সরকারি উদ্যোগে ‘ক্লাস্টার’ গড়া হয়েছিল। কিন্তু সমিতির সঙ্গে যুক্ত তাঁতিদের অনেকে ক্লাস্টারে ঢুকে পড়েছেন। তাঁতিদের অভিযোগ, সরকারি আধিকারিকরা সমীক্ষার সময় ও হ্যাপা বাঁচাতে সমবায় সমিতিতে যাঁরা যুক্ত তাঁদেরই নাম নথিভুক্ত করে নেন। তবে তাতে কাজ বিশেষ হয়নি। গত চার বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্লাস্টার রয়েছে। এক বারই শুধু রঙের কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। ওই পর্যন্তই।
সরকারি আধিকারিকেরা অবশ্য সব অভিযোগ মানতে নারাজ। বাঁকুড়া জেলা হ্যান্ডলুম অফিসার দীপাল নাথ দাবি করেন, কিছু দিন এগ্জিকিউটিভ অফিসার না থাকায় ক্লাস্টারের কাজ বন্ধ ছিল। এখন তা চলছে। প্রধানত বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ হয়। যেমন রঙের ব্যবহার, সুতোর কাজ ইত্যাদি শেখানো হয়। তাঁতিদের নানা মেলায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওয়েবসাইট তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে, যার মাধ্যমে সরাসরি ক্রেতাদের সঙ্গে শিল্পীদের যোগাযোগ হবে। কাগজপত্র জমা দিয়েও মেডিক্লেম পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে কিছু তাঁতি। তার জন্য স্থানীয় সমবায় কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সোনামুখীতে প্রতিনিধি পাঠানোরও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
এই পরিস্থিতিতে কিছু তাঁতি আবার ফ্যাশন ডিজাইনারদের সঙ্গে কাজ শুরু করেছেন। সদানন্দ সুর যেমন কাজ করছেন দুর্গাপুরের অপালা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দশটি তাঁত। কাজের চাপ থাকায় সঙ্গে নিয়েছেন পাড়ার আরও কয়েক জনকে। তসরের থান, রঙিন রেশম, সাদা রেশম যা ‘মালবেরি’ নামে পরিচিত, তাঁরা সব ধরনের কাজই করছেন। পাগড়িও তৈরি করেন। তসর বা মালবেরির পারে বিভিন্ন রং ব্যবহার করা হয়। শাড়ির মেঝেতে দু’টি রঙ বদল করে করেও আনা হয় বৈচিত্র্য। অপালার ডিজাইন অনুযায়ী শাড়ি তৈরি করেন সদানন্দেরা। অপালার কাছেই সেই শাড়ি বিক্রি করে তাঁরা তুলনামূলক বেশি আয় করছেন। অপালা আবার দুর্গাপুর-সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনী করে শাড়ি বিক্রি করেন।
সার্বিক ভাবে রেশম শিল্পীদের সঙ্কট বাড়িয়েছে পলিয়েস্টার সুতো। পলিয়েস্টারে বোনা শাড়ির জৌলুস অনেকটা রেশমের মতোই, কিন্তু দাম অনেক কম। অনেক ক্রেতা না বুঝে রেশমের শাড়ি ভেবে তা কিনছেন। সেই সুযোগে তাঁতিদের বেকাদায় ফেলে কম দামে রেশম শাড়ি কিনে নিতে চাইছেন মহাজনেরা। তাঁতিরা সত্যিই জানেন না, কোন পথে তাঁদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকবে।
এই টানাপোড়েন নিয়েই আপাতত চলেছে সোনামুখীর তসর শিল্প। |