ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন স্থানীয় এক প্রৌঢ়। হাসপাতালে তিনি ভর্তি হওয়া মাত্রই ছুটে এসেছিলেন কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা, কর্মীরা। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা, বাড়ির লোককে আশ্বস্ত করে, এক ছুটে বাজার থেকে কচি ডাব এনে দেওয়ার মতো বেশ কিছু লঘু-গুরু দায়িত্ব হাসিমুখে সামলেছেন তাঁরাই।
এটা যদি প্রথম ছবি হয়, তাহলে দ্বিতীয়টা—সাপে-কাটা এক রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে এসে সারা রাত সেখানেই থেকে গেলেন তৃণমূলের এক নেতা। পরের দিন সেই রোগী হাসপাতাল থেকে ছুটি পেলে নিজের মোটরবাইকে চাপিয়ে তাঁকে নিয়ে গ্রামে ফিরলেন তিনি। যিনি এ বার করিমপুর-১ পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থীও হয়েছেন।
পরোপকারের এই দৌড়ে পিছিয়ে নেই সিপিএম-ও। পাড়ার দুই পরিবারের গন্ডগোল পৌঁছে গিয়েছিল হাতাহাতিতে। আহত হয়ে দুই পরিবারের সদস্যদের ভর্তি হতে হয়। হাসপাতালে টানা দুদিন বাড়ির কাজ ফেলে হাসপাতালে এসে খোঁজখবর নেওয়া থেকে শুরু করে দোকান থেকে ওষুধ এনে দেওয়ার মতোও হ্যাপা সামলেছেন হোগলবেড়িয়া এলাকার সিপিএমের এক নেতা।
হাসপাতালের সুপার রাজীব ঘোষ বলছেন, ‘‘রাজনৈতিক নেতা কারা, আর কারা রোগীর আত্মীয় সেটা তো আলাদাভাবে আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায় এইসময় রোগীদের ‘আত্মীয়দের’ ভিড় বেড়ে গিয়েছে। ভোট বড় বালাই। গত মাসখানেক ধরে রাজনীতির কারবারিদের তাই বড় দরদ!
করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালকে ঘিরে তাঁদের এই পরের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ায় বিড়ম্বিত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। মাসখানেক ধরেই রোগীদের পাশে দাঁড়ানোর এই লড়াই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হাসপাতাল চত্বরে দেখা মিলছে কমবেশি সব রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের। সকলেই লড়ে যাচ্ছে পাশে দাঁড়ানোর দৌড়ে। বাড়ির লোকের সঙ্গে কোন রোগী কথা বলতে চাইলে কেউ পকেট থেকে বের করে দিচ্ছেন নিজের মোবাইল, কেউ আবার রোগীকে বলছেন, ‘‘বারবার বাড়িতে ফোন করার দরকার নেই। কোন দরকার হলে আমাকে বলবেন, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’’ কেউ আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে এসে বলছেন, ‘‘রেফার করে দিলেও ভয়ের কিছু নেই, জেলা হাসপাতালেও আমাদের ছেলেরা আছে সবরকম সহযোগিতা পাবেন।’’
বর্হিবিভাগের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মুরুটিয়ার হাসিবুর শেখ রাজনীতির ‘দাদা’দের এমন রকমসকম দেখে বলছেন, ‘‘কি ব্যাপার বলুন তো? এর আগে এমনটা তো দেখিনি। পনেরো মিনিটের মধ্যে জনা তিনেক লোক এসে জানিয়ে গেল কোনও দরকার হলেই আমি যেন ওদের জানাই। ওরা পাশেই থাকছে।’’ হাসপাতালের শয্যায় বসে এক প্রৌঢ় হাসতে হাসতে জানাচ্ছেন, ‘‘নিজেকে ভিআইপি বলে মনে হচ্ছে জানেন!” হাসপাতালের এক কর্মীর কথায়, ‘‘গত মাসখানেক থেকেই হাসপাতাল চত্বরে দেখা মিলছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের। তাঁরা কেউ আসছেন রোগীকে সঙ্গে নিয়ে, কেউ আবার ভর্তি হওয়া রোগীর খবর নিতে। তবে এ ছবি নতুন নয়, ভোটের আগে এটাই চেনা চিত্র।’’ স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে এটা নতুন কিছু নয়। লোকসভা, বিধানসভার আগেও নেতা কর্মীদের এমন ভিড় হয়। তবে সে সবকে ছাপিয়ে যায় পঞ্চায়েত নির্বাচন। রাজনৈতিক নেতারাও মেনে নিচ্ছেন, এমন কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা সারাবছরই এই কাজটা করে থাকেন। ‘গ্রামীণ সেন্টিমেন্ট’ ছুঁতেই এই পন্থা জানাচ্ছেন শাসক দলের প্রভাবশালী স্থানীয় এক নেতা।
জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক তাপস সাহা যেমন বলছেন, ‘‘কিছু লোকজন সারা বছরই এমন কাজ করেন। তবে এটাও ঠিক যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে এই প্রবণতা বেড়ে যায়।’’ কেন? তাঁর হাসি বুঝিয়ে দেয়, ভোট বাস্তবিকই বড় বালাই।
করিমপুরের কংগ্রেস নেতা তারক সরখেল অবশ্য বলেন, ‘‘করিমপুর হাসপাতালে সারা বছরই তো আমাদের দলের ছেলেরাই রোগীদের নানা ভাবে সহযোগিতা করে। সেটা এখনও চলছে। বরং অন্য দলের লোকজনই এখন ভিড় জমাচ্ছে বেশি।’’ করিমপুরের বিধায়ক সিপিএমের সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, ‘‘সত্যিই মানুষের পাশে দাঁড়ানো আর পাশে দাঁড়ানোর নাটক করা দুটো এক নয়। আর রোগী কিংবা সাধারণ মানুষ সেই পার্থক্যটা যথেষ্ট ভাল বোঝেন। মানুষ কাদের পাশে থাকবেন সেটা বোঝা যাবে নির্বাচনের ফলাফলে।’’ |