ইঙ্গ-অস্ট্রেলিয়া বিরোধের উগ্রতা
চ্যালেঞ্জ করছে বার্মিংহ্যামের মহাসংঘাতকে
র্যটকে থিকথিক করছে লন্ডন শহর! বৃষ্টি বাদলা অগ্রাহ্য করে ছাতা-সহ অথবা ছাতা ছাড়া তারা দৃপ্ত ভাবে শহরের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে যাচ্ছে। যেখানে যাবেন ট্রাফালগার স্কোয়্যার, পিকাডেলি সার্কাস, বেকার স্ট্রিট সর্বত্র তারা বিরাট সংখ্যায়। মাদাম তুসোর বাইরে লম্বা ভিড়। স্ট্র্যান্ডে ম্যাকডোনাল্ডসের দোকানে অন্তত সাত মিনিট দাঁড়ালে তবেই কাউন্টার অবধি পৌঁছনো যাচ্ছে। ঐতিহ্যশালী স্যাভয় থিয়েটারে ফাটিয়ে চলছে ‘দ্য বিটলস আর ব্যাক’। রক অ্যান্ড রোল ব্যান্ডের পঞ্চাশ বছর পূর্তি নিয়ে যে শো-র কথা শোনা যত সহজ, টিকিট সংগ্রহ করা ততই কঠিন।
জাম্প কাট! দেড় ঘণ্টা ট্রেন দূরত্বের বার্মিংহ্যাম হাই স্ট্রিট। স্টেশনের বাইরে যথারীতি এক এক করে কালো ট্যাক্সিগুলো দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু লাইন ঠিক ততটাই লম্বা, হাওড়া স্টেশনে পুরী এক্সপ্রেস এসে থামলে পরবর্তী আধ ঘণ্টায় ট্যাক্সির লাইন যে চেহারা নেয়! হোটেলগুলোতেও সেই অবস্থা। রোববার সকাল অবধি ঘর চাহিয়া লজ্জা দিবেন না।
লন্ডন যদি পর্যটকের কবজায় আপাতত চলে গিয়ে থাকে। বার্মিংহ্যাম দখল করে নিয়েছে ক্রিকেট-পর্যটক!
টুর্নামেন্টের দু’মাস আগে থেকেই শনিবারের এজবাস্টনের টিকিট সব শেষ। হোটেলের বুকিং-টুকিংও লোকে মোটামুটি তখনই সেরে রেখেছে। এমনিতেই বার্মিংহ্যাম পুঁচকে শহর। এমনিতেই তার ধারণ-ক্ষমতা কম। তার ওপর আবার পাকিস্তানি-ভারতীয়তে অধ্যুষিত। এ দিন দুপুরে সিটি সেন্টারের চাইনিজ রেস্তোরাঁ থেকে শোনা গেল যশ চোপড়ার ছবির গান ভেসে আসছে। কিছু পরে ‘ম্যায় হুঁ না’। আশা ভোঁসলের রেস্তোরাঁ এই শহরেই আছে বোঝা গেল। তা বলে বিলেতের চিনা দোকানে যশ চোপড়া! রেস্তোরাঁ কর্মী জানাল, চলতি সপ্তাহে শহরের নতুন অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য এই ব্যবস্থা। যে এলাকার কথা বলছি সেখান থেকে উসেইন বোল্টের গতিতে দুশো মিটার ছুটতে পারলে আঠারো সেকেন্ডে প্লেয়ারদের হোটেল হায়াত রিজেন্সি। দুটো টিম এখানে। মানে দু’পক্ষই উত্তেজনার বৃত্তের মধ্যে।
আইসিসি-ও শুরু থেকেই ভানহীন ভাবে স্বীকার করেছে, গোটা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির চুম্বক লুকিয়ে রয়েছে এজবাস্টনের একটা ম্যাচে!
অথচ ডার্বির ছত্রিশ ঘণ্টা আগে কোথাও যেন মনে হচ্ছে, বহু প্রতীক্ষিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার জৌলুস যেন আক্রান্ত। আর তার একমাত্র কারণ দুপুর থেকে বার্মিংহ্যামের বৃষ্টি নয়। যা পাকিস্তানিদের ইন্ডোর নেটে চলে যেতে বাধ্য করল।
তার কারণ, পরিস্থিতি! একে তো একটা টিম সেমিফাইনাল চলে গেছে চ্যাম্পিয়নশিপ ফেভারিটের মতো খেলতে খেলতে। আর তার প্রতিপক্ষ কিনা লড়াইয়েই নেই। টুর্নামেন্ট থেকেই বিদায়ী।


• ৬৭ ওয়ান ডে-তে ভারত জিতেছে ২৭টি। পাকিস্তান ৩৮টি। ফলহীন ২।
• চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দু’বার মুখোমুখি লড়াইয়ে দু’বারই জিতেছে পাকিস্তান।
২০০৪-এ ইংল্যান্ডে ৩ উইকেটে জয়ে ম্যাচের সেরা ইউসুফ ইউহানা। ২০০৯-এ
দক্ষিণ আফ্রিকায় ৫৪ রানে জয়ে ম্যাচের সেরা শোয়েব মালিক।
‘‘ভারত চ্যাম্পিয়নের মতো খেলছে। ফাইনালেও ওরাই খেলবে মনে হচ্ছে। ওদের শক্তিটা ব্যাটিংয়ে।
বীরেন্দ্র সহবাগ, রাহুল দ্রাবিড়, সচিন তেন্ডুলকর আর গৌতম গম্ভীরের মতো প্লেয়ারের অনুপস্থিতিতেও
৩০০ প্লাস রান তুলছে। শিখর ধবন আর রবীন্দ্র জাডেজার মতো নতুন দু’জন ম্যাচ উইনারও উঠে এসেছে।
ভারতই এগিয়ে থাকবে শনিবারের লড়াইয়ে। তবে পাকিস্তানও চমকে দিতে পারে।’’ —

তার ওপর চড়ছে অ্যাসেজ নিয়ে স্থানীয় উত্তাপ। ওভালে প্রথম সেমিফাইনালের টিকিট পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিন্তু লর্ডসে ১০ জুলাইয়ের টিকিট নাকি ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ছে। ওয়ার্নার-গেট আরও উস্কে দিয়েছে অ্যাসেজ নিয়ে কামড়াকামড়ি। ইয়ান বোথাম শুরু করেছিলেন ‘এই অস্ট্রেলিয়াকে ১০-০ হারানো সম্ভব’ বলে। ওয়ার্নারের ঘটনার পর এখন প্রতি মুহূর্তে যেন রেডিও-টিভি-টুইটার-ফেসবুকে অ্যাসেজ নিয়ে ইংরেজ ক্রিকেটারদের কোনও না কোনও মন্তব্য বার হচ্ছে। শেন ওয়ার্ন এ দিন নিজের কলমে পাল্টা বলেছেন, ‘আমি দেখছি ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটার আর সাংবাদিকেরা নেমে পড়েছেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু আমার মনে হয় এই ওয়ার্নারকে ঘিরে অপমানজনক বিতর্কটাই টিমের প্রত্যাবর্তনের মশালটা দপ করে জ্বালিয়ে দিতে পারে।’
ওয়ার্ন লিখছেন, ‘আমরা একটা সহজ নিয়ম মেনে চলতাম, বিফোর মিডনাইট ইজ ইয়োর টাইম। আফটার মিডনাইট ইজ ক্রিকেট টাইম। যা কিছু করার বাবা মধ্যরাতের আগে সেরে নাও। যা মন চায় প্রাণ চায়। যে-ই মধ্যরাত হয়ে গেল, ক্রিকেটকে সঁপে দাও। শৃঙ্খলাটা তো দরকারই। এক বার আইপিএল টিম ট্রেনিংয়ের সময় রবীন্দ্র জাডেজা বাসে উঠতে দেরি করায় আমরা বাস নিয়ে চলে গেছিলাম। জাডেজা মুম্বইয়ের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফেরে। আর কখনও বাসে লেট করেনি। তবে ওয়ার্নারই এখন শুধু শিক্ষা নেবে না, গোটা টিম একত্রিত হবে। আমার মনে হচ্ছে ওদের যেমন ক্যাবলা ক্যাবলা দেখাচ্ছিল। এই ঝাঁকুনিটা শাপে বর হয়ে দেখা দিল।’ মাইক আথারটন আবার যে কলম লিখেছেন, সেটা পড়লে মনে হবে অস্ট্রেলিয়ার কাটা ঘায়ে আরও নুনের ছিটে ছড়িয়ে দিতে চাইছে ইংরেজরা। অর্কেস্ট্রার মতো প্রচার শুরু হয়ে গেছে, যুগে যুগে হারতে শুরু করলেই অস্ট্রেলিয়ানদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। আর তখন ওরা অসভ্যতা করে। শোনা যাচ্ছে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট-কর্তা জেমস সাদারল্যান্ড ঘটনাপ্রবাহে চরম উত্তেজিত। শুধু ওয়ার্নার নন, তিনি জবাবদিহি চাইবেন কোচ মিকি আর্থারের কাছেও। ইংল্যান্ডের কাছে ম্যাচ হারার পর মধ্যরাতের পরে সেই ইংল্যান্ডের ছেলেদের সঙ্গেই বসে মদ খাওয়ার অনুমতি ওদের কে দিল? অভিযোগের মূল সুর: মধ্যরাতের পর যদি বা খেতে পারো, ম্যাচ হারিয়ে দেওয়া চিরশত্রুদের সঙ্গে বসলে কেন?
যত এ সব লেখালিখি, প্রচার আর বিনিময় হচ্ছে তত যেন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সাবেকি চৌম্বক ক্ষেত্রকে আক্রান্ত দেখাচ্ছে— ভারত বনাম পাকিস্তান!
অন্য বার এই সময় বিশেষজ্ঞদের প্রিভিউ আর মতামতের ঝড় বয়ে যায়। এ বার দুটো টিমকে ওজনে এত আলাদা দেখাচ্ছে যে সেই আলোচনাটাই নেই। বরং ছিদ্রান্বেষী বিলিতি প্রেসও মেনে নিচ্ছে, ধোনির ছেলেরা জাস্ট মাতিয়ে দিচ্ছে। অরুণ লাল কাল বলছিলেন, “আমি দ্বিধায় পড়ে যাচ্ছি। এক বার মনে হচ্ছে ভারতীয় নির্বাচকদের অভিনন্দন জানাই যে, বয়স্ক তারকাদের বাদ দিয়ে কী বিচক্ষণী সিদ্ধান্তই না নিয়েছেন। পরমুহূর্তে মনে হচ্ছে এই বদলটা কি আরও আগেই করা যেত না!” পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে অনিবার্য আলোচনাতেই গেলেন না অরুণ। আর দুটো ম্যাচ জিতলেই ভারত চ্যাম্পিয়ন। যার মধ্যে শনিবারটা পড়ছে না। ওটা হারলেও চলবে।
সে জন্যই কি না জানি না, আর পাঁচটা পাকিস্তান ম্যাচের আগে ধোনির ভারতকে যত টেনশনাক্রান্ত দেখায় এ বার তার ছিটেফোঁটাও নেই। ম্যাচের আগের আগের দিনের রুটিন পুল সেশন আজ হল কি না জানি না। হয়তো হল, হয়তো হল না। কিন্তু সক্কাল সক্কাল প্রায় গোটা টিম বেরিয়ে গেল শপিং করতে। টিম বাস গেছিল এক ঘণ্টা দূরের অক্সফোর্ডশায়ারে। সেখানকার বিস্টার ভিলেজ শপিং মল হচ্ছে ব্রিটেনের বৃহত্তম আউটলেট মল। যেখানে সমস্ত ডিজাইনার পোশাক পঞ্চাশ থেকে ষাট পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে পাওয়া যায়। প্যাকেট বোঝাই করে যখন বিকেলে টিম ফিরছে, এক চ্যানেলের ফটোগ্রাফার ছবি তুলতে গেছিলেন। হাত দিয়ে আটকালেন ম্যানেজার রঞ্জীব বিসওয়াল। বললেন, এই ছবি নয়। বোঝা গেল পাকিস্তান ম্যাচের আগের আগের দিন শপিংয়ের বাড়তি প্রচার চাইছে না টিম। শুক্রবার যথারীতি তারা প্র্যাক্টিসে যাবে। কিন্তু হাবেভাবে চিরাচরিত পাক ম্যাচ বিরোধী অভিব্যক্তিই যেন ফুটে উঠছে। এক কথায় যার নাম শৈত্য।
উত্তাপটা বার্মিংহ্যামে আগত ক্রিকেট পর্যটকের সংখ্যা আগামী এক দিনে যত বাড়বে, তার সঙ্গেই হয়তো বাড়বে। এখনকার মতো তার যেটুকু আগুন আসার, আসছে পাকিস্তান শিবির থেকে। টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় হওয়ায় মুল্লুকে যতই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ঝড় বইতে শুরু করুক। একটা ম্যাচ জিতলে অন্তত লাহৌর বিমানবন্দর থেকে বার হওয়ার সময় ডিমের খোসা মুখে পড়বে না!
গত দেড় বছর পাকিস্তান টিমের প্রশাসনিক দায়িত্বে রয়েছেন নভিদ আক্রম চিমা। আবলুশ কাঠের মতো কড়া চেহারার এই লোকটি অসম্ভব কড়া। যবে থেকে তিনি টিমের দায়িত্বে, আর স্পট-ফিক্সিং জাতীয় ন্যূনতম বিতর্কও মাথা চাড়া দেয়নি চিরকলঙ্কিত পাকিস্তান ঘিরে। এই চিমা গতকাল এজবাস্টনে চল্লিশ মিনিট ক্লাস নিয়েছেন ছেলেদের। তাঁর মূল লক্ষ্য পারফর্ম না করতে পারা টিমের তিন সিনিয়র ক্রিকেটার। শোয়েব মালিক, ইমরান ফরহাত এবং কামরান আকমল। ছেলেদের তিনি বলেছেন, শনিবারের ওপর তোমাদের অনেকের কেরিয়ার নির্ভর করে রয়েছে মনে রেখো। দেশের হয়ে যদি আবার খেলতে চাও, শনিবার জানপ্রাণ দিয়ে লড়ো। যদি ম্যাচটা বার করতে পারো টুর্নামেন্ট ঘিরে শোকের মধ্যেও পাক জনতাকে একটা বোনাস উপহার দিতে পারবে।
দুপুরের টানা বৃষ্টি পাত্তা না দিয়ে যে ভাবে গোটা পাকিস্তান অনুশীলনে চলে গেল। সেটা দেখে মনে হচ্ছে দেশবাসীকে তাদের বোনাস উপহার দেওয়ার রোখে যদি ম্যাচটাকে জাগিয়ে দেয়। যতক্ষণ না সেটা ঘটছে, অ্যাডভান্টেজ অ্যাসেজ!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.