ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রাণপাত করিতেছে এবং অন্যান্য যাবতীয় ক্ষেত্রের মতো নব্বই শতাংশ প্রতিশ্রুতিই পালন করিয়া ফেলিয়াছে, শোনা যায়। রাজ্যের সংখ্যালঘু কমিশনের রিপোর্ট বলিতেছে, দাবিটি অযথার্থ। স্বাভাবিক। ধর্মীয় সংখ্যালঘু বলিতে যে-রাজনীতিকরা কেবল মুসলিম সমাজের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তিকে বোঝেন, তাঁহাদের কাছে সমাজের সামগ্রিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি গুরুত্ব পাওয়ার কথা নয়। মুসলিমরা রাজ্যের ভোটদাতাদের এক-তৃতীয়াংশ, তাই সংখ্যালঘু উন্নয়নের নামে মুসলিম নেতৃস্থানীয়দের প্রতীকী ও প্রসাধনী প্রসাদ-বিতরণেই সরকারের উন্নয়ন-যজ্ঞ সীমাবদ্ধ থাকে।
বাম আমলেও সাচার কমিশনের রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের দুরবস্থার এমনই করুণ চিত্র ফুটিয়া উটিয়াছিল, একই কারণে। তখন সেই উপলক্ষে বাম-বিরোধী রাজনীতির মঞ্চ হইতে তুমুল সমালোচনার ঝড় ওঠে। রাজ্যে বামদের প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী তদবধি সংখ্যালঘু উন্নয়নের লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতি দিতে থাকেন। লক্ষণীয় যে, তাঁহার সরকারের দুই বছর কাটিয়া যাওয়ার পরও কিন্তু সেই সব লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতির টিকিটিও দৃশ্যমান নহে। সংখ্যালঘুরা যে-তিমিরে ছিলেন, সেখানেই আছেন। কেবল তাঁহাদের উন্নয়নের নামে কিছু প্রতারণামূলক, অন্তঃসারশূন্য, গাল-ভরা লোকদেখানো প্রকল্প ঘোষিত হইয়াছে।
আর হইয়াছে কিছু বিপজ্জনক প্রকল্প, যেমন ইমাম-ভাতা। সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ও ভাবনাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া ইমাম ও মুয়েজ্জিনের মতো ধর্মীয় আধিকারিকদের জন্য রাজ্যের এই মাসিক ভাতার আর্থিক দায় ১২৫ কোটি টাকা। এই অর্থ কিন্তু দরিদ্র মুসলিম বস্তিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসনের মতো বুনিয়াদি পরিকাঠামো নির্মাণে লগ্নি হইতে পারিত। মাদ্রাসাগুলিকে বিশেষ সমর্থন দানের সিদ্ধান্ত হইয়াছে, অথচ মুসলিম পড়ুয়াদের মাত্রই ৪ শতাংশ রাজ্যের মাদ্রাসাগুলিতে পড়িতে যায়। খারিজি মাদ্রাসা শিক্ষার সহিত মৌলবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের প্রসারের সম্পর্কও অবশ্যবিচার্য। ইহার দ্বারা সংখ্যালঘুর সত্যই উন্নয়ন সম্ভব, নাকি অতীতচারী এই তোষণনীতি সমগ্র সম্প্রদায়কে আরও পিছাইয়া দিতেই উদ্যত হয়, ভাবা প্রয়োজন। বোঝা দরকার যে, সংখ্যালঘু বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন নির্ভর করে তাহার ক্ষমতায়নের উপর। আর ক্ষমতায়ন নির্ভর করে তাহার কর্মসংস্থানের সুযোগের উপর। অথচ রিপোর্ট বলিতেছে, এখানেও দেখা যাইতেছে, পুলিশ কনস্টেবলের মতো ন্যূনতম যোগ্যতার সরকারি চাকুরিতেও মুসলিমদের সংখ্যা মাত্রই ৯-১০ শতাংশ। বছরে একশো দিনের গ্রামীণ রোজগার যোজনাতে ১৩ শতাংশ মুসলিম। বৃত্তিমূলক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষাতেও মুসলিমরা গড়ে ৭ হইতে ১৩ শতাংশ হারে নিযুক্ত হইতেছে। এ ভাবে কি সামাজিক অন্ত্যোদয়ের অভিমুখে যাত্রা সম্ভব? |