নরেন্দ্র মোদীই যে ২০১৪ সালে বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হইতে চলিয়াছেন, তাহা খাতায়-কলমে ঘোষণাটুকুই অবশিষ্ট আছে। মোদীর এই উত্থান হজম করা যাঁহার পক্ষে কঠিনতম, তিনি লালকৃষ্ণ আডবাণী নহেন। তাঁহার নাম নীতীশ কুমার। ২০১০-এর শেষে যখন তিনি বিপুল ভোটে জিতিয়া পটনার ক্ষমতাকেন্দ্রে ফিরিয়া আসিলেন, তখন হাওয়ায় ভাসিতেছিল, হয়তো ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে তিনিই হইবেন এনডিএ-র মুখ। সে সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হয় নাই। তাঁহার সংযুক্ত জনতা দল এনডিএ-তে থাকিলেও নীতীশ কুমারের রাজ্যপাট বিহারেই সীমিত থাকিবার ইঙ্গিত এখন স্পষ্ট। রাজ্য রাজনীতিতে তাঁহার সাফল্যের একটি কারণ অবশ্যই তাঁহার ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভাবমূর্তি, যাহার ফলে এনডিএ-র শরিক হইয়াও মুসলিম ভোট অর্জনে তাঁহাকে বেগ পাইতে হয় নাই। নরেন্দ্র মোদীকে মানিয়া লইলে সেই নিশ্চিন্ত ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরিবে, তাহাই নীতীশ কুমারের আশঙ্কা। আরও বড় সমস্যা, কেবল তাঁহার ভোট কমিবে এইটুকুই নয়, তাঁহার ভোট সম্ভবত সবেগে ধাবিত হইবে রাজ্য রাজনীতির প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের প্রতি। তদুপরি লোকসভা ভোটের মুখে বিহারে যদি কংগ্রেস লালুপ্রসাদ যাদবের সহিতই জোট বাঁধিতে সিদ্ধান্ত লয়, তবে সেই সম্মিলিত পক্ষেই মুসলিম ভোটের সিংহভাগ চলিয়া যাওয়ার সম্ভাবনা। অন্য দিকে, এন ডি এ তথা বিজেপি-র সঙ্গ ছাড়িলে উচ্চবর্ণের ভোট খোয়াইবার সম্ভাবনা। এই জাঁতাকলের মুখে পীড়িত অবস্থায়ও নীতিশ কুমার বিলক্ষণ জানেন, ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনই পাখির চোখ হইলে দাঁড়িপাল্লা কোন দিকটিতে ঝুঁকিয়া আছে।
বিজেপি-র কর্মসমিতির বৈঠকে মোদীর পদোন্নতির সংবাদ ঘোষিত হইবার অব্যবহিত পূর্বেই বিহারে মহারাজগঞ্জ কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়: প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রীয় জনতা দলের হাতে বিপুল পরাজয় নীতীশ কুমারকে রাজনৈতিক ভাবে কোণঠাসা করিয়া ফেলে। একটি উপনির্বাচনের ফলাফলকে তাহার প্রাপ্য গুরুত্বের অধিক না দেওয়াই বিধেয়। সেই ফলের ভিত্তিতে রাজ্য রাজনীতির চলন অনুমান মুশকিল। কিন্তু দৃশ্যতই লালুপ্রসাদ যাদব ফের শক্তি অর্জন করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। এবং নীতীশ কুমার উপলব্ধি করিতেছেন, বিজেপি-র সঙ্গ ত্যাগ করিলে বিহারে তাঁহার লড়াই অন্তত ত্রিমুখী হইবে। মহারাজগঞ্জ-উত্তর পর্বে এই উপলব্ধিটিই তাঁহার এনডিএ-ত্যাগের সিদ্ধান্তের পথে বৃহত্তম বাধা হইয়া উঠে। মহারাজগঞ্জে রাষ্ট্রীয় জনতা দল কেন আচমকাই শক্তিশালী হইয়া উঠিল, এখনও তাহা অস্পষ্ট। বিজেপি-র জনৈক মন্ত্রীর মন্তব্য, মোদী-প্রশ্নে নীতীশ কুমারের আপত্তির কারণেই বিজেপি কর্মীরা ভোটের কাজে তেমন গা করেন নাই। কিন্তু, তাহা বলিয়া বিজেপি সমর্থকরা কেন রাষ্ট্রীয় জনতা দলের ঝুলিতেই ভোটটি ফেলিবেন, তাহার ব্যাখ্যা নাই দুই পক্ষের সম্পর্ক পূর্বে যেমন তিক্ত ছিল, এখনও তেমনই আছে। অতএব, অনুমান করা সম্ভব, বিহারের আদি ও অকৃত্রিম জাতপাতের সমীকরণেই মহারাজগঞ্জের উপনির্বাচনে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের প্রার্থী এক লক্ষ ছত্রিশ হাজার ভোটে জিতিয়াছেন। রাজ্য রাজনীতির হিসাব কষিবার সময় এই কথাটি সব পক্ষেরই স্মরণে থাকিবে।
নীতীশ কুমার যে নরেন্দ্র মোদীর সহিত রাজনীতির এক পৃষ্ঠায় ঠাঁই পাইতে তিলমাত্র আগ্রহী নহেন, তাহা বহু দিন যাবৎ স্পষ্ট। অধুনা, তাঁহারা সরাসরি যুযুধান। এই সম্মুখসমরের মঞ্চ হিন্দুত্ববাদ/ধর্মনিরপেক্ষতার সাপেক্ষে নির্মিত। এই মহাড়ম্বর মল্লযুদ্ধ দেখিতে দেখিতে সহসা একটি আক্ষেপ উপস্থিত হওয়া স্বাভাবিক। মনে পড়া স্বাভাবিক যে, এই লড়াইয়ের মঞ্চ হইতে পারিত উন্নয়ন। উভয়েই মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে উন্নয়নের জন্য খ্যাত, কিন্তু তাঁহাদের উন্নয়নের ঘরানা পৃথক। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পরীক্ষা হইতে পারিত, উন্নয়নের কোন্ মডেল অধিক কার্যকর। কিন্তু দুর্ভাগ্য, রাজনীতির পাটিগণিতের চক্র সেই জাতপাত-ধর্মের অধ্যায়ে আসিয়াই বারবার থামে। কেবল বিহারে নহে, সমগ্র ভারতেই সমানে উন্নয়নকে ছাপাইয়া উঠে ধর্ম কিংবা জাতপাতের প্রশ্ন। দুর্ভাগ্য। সনাতন রাজনীতি আসিয়া ভারতীয় ভোটের ময়দান হইতে এই ভাবেই উন্নয়নকে লইয়া যায়। |