ঘুটঘুটে অন্ধকার। অতলান্তিকের কনকনে ঠান্ডা জলে শরীর অসাড়। নোনা জলে গায়ের ছাল উঠে গিয়েছে। তবু কোনও মতে শুধু ভেসে থাকার চেষ্টা।
আসলে বাঁচার লড়াই। যদিও প্রতি মুহূর্তে মনের জোর খানখান করে দিচ্ছিল বাতাসের পচা গন্ধটা। টের পাইয়ে দিয়েছিল, আশপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বন্ধুদের মৃতদেহ।
হলিউডি ছবি নয়। ঘোর বাস্তব। মাঝসমুদ্রে উল্টে যাওয়া এক বড়সড় নৌকোয় আটকে পড়েছিলেন হ্যারিসন ওকেন। সম্প্রতি নিজেই জানালেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা। হঠাৎই উল্টে যাওয়া নৌকোটিতে তারই মতো আটকে পড়েছিল খানিক বাতাসও। সামান্য সেই অক্সিজেনকে সম্বল করে চালিয়ে গেলেন বেঁচে থাকার লড়াই। যুদ্ধ থামল আড়াই দিন পরে। যখন জাহাজ সংস্থার কর্মীরা এসে উদ্ধার করলেন তাঁকে।
২৬ মে-র ঘটনা। নাইজেরিয়ার উপকূল থেকে অতলান্তিকের ৩০ কিলোমিটার গভীরে ভাসছিল টাগবোট ‘জ্যাসকন-৪’। টাগবোট হল বড়সড় একটা জাহাজ। তেলের ট্যাঙ্কার বা কোনও জলযান খারাপ হলে সেটাকে টেনে এনে বন্দরে ভেড়ানোই এর কাজ। ঘড়িতে তখন ভোর পাঁচটা। একটা বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ল জ্যাসকনের উপর। দুলে উঠল নৌকো, কিছু বোঝার আগেই অতলান্তিকের গভীরে উল্টে গেল ‘জ্যাসকন-৪’।

হ্যারিসন ওকেন |
নৌকোয় লোক বলতে ১২ জন কর্মী। এঁদেরই এক জন ওকেন। পেশায় রাঁধুনী। নৌকোটি উল্টে যাওয়ার সময় তিনি শৌচাগারে ছিলেন। জ্যাসকন উল্টোতেই হুড়মুড়িয়ে জল ঢুকতে থাকে ছোট্ট জায়গাটায়। শৌচাগারের লোহার দরজাটা টেনে খোলার চেষ্টা করেন ওকেন। দরজা খুলতেই ঘন অন্ধকার। আশপাশেই সহকর্মীদের গলার আওয়াজ শুনতে পান। ওকেন বলেন, “একে অপরকে সতর্ক করে দিই, কাছাকাছি থাকতে হবে। একটু এগোতেই প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়ে জল। আমার সামনে আরও তিন জন ছিল। একটা ঢেউ নিমেষে ভাসিয়ে নিয়ে গেল তিন জনকেই। ওঁরা কেউই যে বেঁচে নেই, তখনই জানতাম।” আর সাহস করে এগোতে পারেননি ওকেন। গোটা একটা দিন শৌচাগারের এক ফালি জায়গাটাতে বেসিন ধরে ঝুলতে থাকেন তিনি। একটু অক্সিজেনের আশায় কোনও মতে জলের উপর ভাসিয়ে রাখেন মুখটাকে। যদিও মনের জোর তখন তলানিতে। সে সঙ্গে প্রচণ্ড খিদে, তেষ্টা। সমুদ্রের নোনা জল মুখে ঢুকে ছাল উঠে গিয়েছে জিভের।
২৪ ঘণ্টা কাটতে সামান্য সাহস এল। জলও ক্রমশ বাড়ছে। অগত্যা কোনও মতে সাঁতরে একটা কেবিনে ঢুকলেন ওকেন। ঠান্ডা কনকনে জলে তিনি কিন্তু একা নেই। বললেন, “অন্ধকারে কিছু ঠাহর করতে পারছিলাম না, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম আশপাশেই বন্ধুদের দেহগুলো রয়েছে। বিচ্ছিরি একটা পচা গন্ধ।” সে গন্ধ বোধহয় টের পেয়েছিল আরও কেউ। “কিছু ক্ষণ পরেই হানা দিল মানুষখেকো মাছেদের দল। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম তাদের খাওয়ার শব্দ... গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।” দেরি করেননি ওকেন। অফিসারের কেবিনের দেওয়াল থেকে কাঠ চিড়ে একটা তক্তা বানিয়ে ফেলেন। আর এক মুহূর্ত জলে থাকা নিরাপদ নয়।
এ দিকে, জ্যাসকনের কর্মীদের দেহগুলো উদ্ধার করতে তত ক্ষণে চলে এসেছেন জাহাজ সংস্থার লোকেরা। দেহই বটে, জাহাজ উল্টে যাওয়ার ৬০ ঘণ্টা পরে আর কেউ বেঁচে নেই বলে ধরেই নিয়েছিলেন তাঁরা। ওকেনের কথায়, “হঠাৎই দেওয়ালে হাতুড়ি পেটানোর আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে সাঁতরে যাই সে দিকটায়। একটা ভারী জিনিস দিয়ে আমিও আওয়াজ করি। ওরাও নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছিল।” একটা টর্চের আলো এসে পড়ল। বললেন, “আমাকে হাত নাড়তে দেখে চমকে গেলেন লোকটি। তবে সে চমকে ছিল এক অদ্ভুত আনন্দ, প্রশান্তি।” |