বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বলতেন, রাজ্যে কারখানা গড়বেন। কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। গ্রামের ছেলেমেয়েরা চাষ নয়, কারখানায় চাকরি করবে। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ব্লকে ব্লকে আইটিআই কলেজ চালুর কথা ঘোষণা করছেন। কিন্তু বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জঙ্গলমহলের তফশিলি জাতি ও উপজাতির ছেলেমেয়েদের নিখরচায় কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রকল্প বাম জমানায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তৃণমূলের সরকার তা শুরু করেনি। তাই প্রশিক্ষণ শেষ করতে না পারা পুরুলিয়ার ছেলেরা অনেকেই চাষবাসের কাজেই ফিরে গিয়েছেন। ভেঙে গিয়েছে তাঁদের স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্নও।
প্রশাসন সূত্রের খবর, রাজ্যের পিছিয়ে পড়া এলাকার চারটি এবং পুরুলিয়া পলিটেকনিক কলেজে তফশিলি জাতি ও জনজাতির ছাত্রছাত্রীদের নিখরচায় কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। মেয়াদ ছিল এক বছরের। ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি দেওয়া হত। ভর্তি নেওয়া হত সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে। আসন ছিল ১০০টি। পুরুলিয়া পলিটেকনিক কলেজে দুই ও তিন চাকার গাড়ি, ডিজেল পাম্পসেট মেরামত, ওয়েল্ডিং ও পোশাক তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। ২০০৭-০৮ সালে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বছর ঠিকঠাক প্রশিক্ষণ চালু থাকলেও ২০০৯-১০ সালে প্রশিক্ষণ অর্থাভাবে মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। ওই বছর বিভিন্ন ব্লক থেকে ৯৭ জন ভর্তি হয়েছিলেন। সেই থেকে জঙ্গলমহলের ছেলেমেয়েদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ থমকে গিয়েছে।
প্রশাসনের পক্ষে এই প্রশিক্ষণ দেখভাল করত অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর। পলিটেকনিক কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বরাদ্দ চেয়ে অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তাঁদের অভিযোগ, টাকা মেলেনি। তাই প্রশিক্ষণও আর চালু হয়নি। পুরুলিয়া পলিটেকনিক কলেজের অধ্যক্ষ গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “চালু হওয়ার সময় আমি এখানে ছিলাম না। পুরো বিষয়টি না জানলেও অর্থের অভাবেই প্রশিক্ষণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে জানি।” পলিটেকনিক কলেজের তৎকালীন টিচার-ইনচার্জ লাল বাহাদুর সিং বলেন, “অবসর নিয়েছি। কিন্তু কেন বন্ধ হয়েছিল এখন তা মনে নেই।” অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) সবুজবরণ সরকার বলেন, “বিষয়টি জানা নেই। খোঁজ নেব।”
তবে অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত আশ্বাসন সংক্রান্ত সরকারি প্রতিশ্রুতি বিষয়ক কমিটি দ্বিতীয় প্রতিবেদনে (২০১২-১৩) জানিয়েছে, ওই প্রকল্প চলত কেন্দ্রীয় সহায়তায়। ঠিক হয়েছিল, পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের সরকারি বা বেসরকারি ক্ষেত্রে নিযুক্ত করা হবে। তা না হলে রাজ্য তফশিলি জাতি, আদিবাসী উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের অর্থানুকুল্যে স্বনিযুক্ত করা হবে। ওই কমিটির দাবি, রাজ্য অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর জানিয়েছে, জেলার প্রোজেক্ট অফিসাররা কোর্সগুলি সম্পর্কে রিপোর্ট না পাঠানোয় দফতরও তা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠাতে পারেনি। তাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ। পুরুলিয়ার অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ আধিকারিকের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। তাঁর দফতর সূত্রেও রিপোর্ট পাঠানো সম্পর্কে কোনও তথ্য মেলেনি।
প্রশাসনের কর্তাদের চাপানউতোর অব্যাহত। বন্ধ প্রশিক্ষণ। ২০০৯-১০ সালে পুরুলিয়া পলিটেকনিক কলেজে প্রশিক্ষণের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন হুড়া ব্লকের পিঁড়রলিয়া গ্রামের যুবক জ্যোতিলাল মুর্মু। তাঁর কথায়, “এলাকায় ডিজেল পাম্পসেটের ভাল কারিগরের চাহিদা ছিল। স্নাতক হয়ে ঘরে বসেছিলাম। বিজ্ঞাপন দেখে ডিজেল পাম্পসেট মেরামত পাঠক্রমে ভর্তি হই। কিন্তু প্রশিক্ষণ শুরু হয়েই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাজও শিখলাম না।” |