জাতীয় বিরোধী দল বিজেপি যে অভ্যন্তরীণ উথালপাথালের মধ্য দিয়া যাইতেছে, প্রতিপক্ষ ও শাসক দল কংগ্রেসের নেতৃত্ব তাহার প্রতিক্রিয়ায় আপাত-মৌন অবলম্বন করিয়াছে। ভাবখানা এ সব বিজেপির নিজের ভিতরকার কাজিয়া, এ বিষয়ে কংগ্রেসের কোনও মাথাব্যথা নাই। অথচ মাথাব্যথা যে একেবারে নাই, তাহা নিশ্চিত করিয়া বলা কঠিন। কেননা বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব হইতে কার্যত লালকৃষ্ণ আডবাণীর বিদায় এবং নরেন্দ্র মোদীর তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মধ্যে কংগ্রেসের রাজনৈতিক সঙ্কটের আগমনী রহিয়াছে বইকী! গুজরাতের ‘হৃদয়সম্রাট’ হইতে সমগ্র দেশের হবু প্রধানমন্ত্রিত্বের অভিযাত্রায় মোদীর সফল হওয়ার অর্থ বিজেপি-র রাজনৈতিক শক্তিবর্ধন এবং কংগ্রেস তথা ইউপিএ-র রাজনীতির পক্ষে সমূহ সঙ্কট। তাই কংগ্রেস মুখপাত্র যখন মোদী-আডবাণী কাণ্ডকে বিজেপির অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলিয়া পাশ কাটাইতে সচেষ্ট হন, তখন সেই অবস্থানকে নির্বাচনী যুদ্ধকৌশলের দিক দিয়া দুর্বল মনে হয়। মনে হয়, বিজেপি-র এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব হইতে যে আদর্শ-সংকট প্রতিফলিত, তাহাকে ‘কাজে লাগাইবার’ সুযোগটি এতদ্দ্বারা বিনষ্ট হইল।
কংগ্রেস মুখপাত্র অবশ্য অন্য একটি গুরুতর মন্তব্য করিয়াছেন। দুইটি তারিখ দিয়া (১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি এবং ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর) বিজেপিকে সংজ্ঞায়িত করার উপর জোর দেওয়া হইয়াছে। প্রথমটি গাঁধী হত্যার, দ্বিতীয়টি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিন। বিজেপি-র রাজনীতি আদর্শের সঙ্গে এই দুইটি দিনের গভীর সংযোগ ভারতবাসীর স্মৃতিপথে নূতন ভাবে উদ্বোধিত করা হইতেছে। ২০০২-এর গুজরাত, ১৯৯২-এর অযোধ্যা অথবা ১৯৪৮-এর দিল্লির দুঃস্বপ্ন ভারতবাসীর মনে নূতন ভাবে জাগাইতে চাহে তাহারা। সুতরাং জাতীয় রাজনীতির প্রধান দুই দল আপাতত তাহাদের মৌলিকতম রাজনৈতিক রেটরিক-এর অঙ্গনে পুনর্যাত্রায় ব্যস্ত। বিজেপি-র দাবি, সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ নেহাতই আপতিক, আসল কথা ইউপিএ সরকারের দুর্নীতির বিপরীতে নিজ মহিমায় গৌরবান্বিত মোদী-শাসিত গুজরাতের সুশাসন-মডেল। আর কংগ্রেসের ভরসা, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পুরানো ধুয়ার দ্বারা বিজেপির মোকাবিলা। বিজেপি-র লক্ষ্য, কংগ্রেস নেতৃত্বের নাছোড় পরিবারতান্ত্রিকতা। আর কংগ্রেসের লক্ষ্য, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সহিত বিজেপির নিবিড় নৈকট্য এবং বিজেপির উপর সঙ্ঘ-পরিবারের শ্বাসরোধকর নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উত্থাপন।
লক্ষণীয়, কংগ্রেসের এই অবস্থান কতখানি রক্ষণাত্মক। একের পর এক দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে জর্জরিত কংগ্রেস নিতান্ত নিরুপায়। আর্থিক সংস্কার কর্মসূচি রূপায়ণে, অন্যান্য নীতি-প্রণয়নে যে নিশ্চেষ্টতার পরিচয় দিয়াছে ইউ পি এ সরকার, তাহার দায় মনমোহন সিংহ ও সনিয়া গাঁধীর উপরেই বর্তায়। তাই একাদিক্রমে দশ বৎসর শাসনের পর হাতে কেবল পেনসিল: কেবলই ধর্মনিরপেক্ষতার পুরাতন আদর্শ-অলঙ্কার। কর্নাটকের মতো দেশের একমাত্র দক্ষিণী রাজ্যে বিজেপির সমূহ পরাভব ও কংগ্রেসের চমকপ্রদ পুনরুত্থানও সে ভাবে কাজে লাগানো যায় নাই, কেননা সে রাজ্যে বিজেপি-র ব্যাপক দুর্নীতির প্রতি আঙুল তুলিলে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকেও একসঙ্গে অনেকগুলি আঙুল উঠিবার সম্ভাবনা। কংগ্রেস নেতৃত্ব কি বুঝিতে পারিতেছেন, নরেন্দ্র মোদী তাঁহাদের কত বড় উপকার করিলেন? সম্বলহীন অসহায়ের হাতে চিরপুরাতন শেষ সম্বল ধর্মনিরপেক্ষতার বাণীটি উপহারস্বরূপ তুলিয়া দিলেন? বিজেপি-র প্রধান মুখ হিসাবে মোদী নির্বাচিত না হইলে যে এটুকু সম্বলও কংগ্রেসের জুটিত না! তবে উপহার যখন পাইয়াছেন, কংগ্রেস নেতৃত্বের উচিত আরও আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে যুদ্ধাঙ্গনে নামা। শেষ পর্যন্ত জয় হউক কিংবা পরাজয়, লড়াইয়ের ময়দান প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়া দেওয়া রাজনৈতিক মল্লযুদ্ধে অসমীচীন কাজ। প্রয়োজনে কূটনীতি জরুরি। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার মোদী-প্রভাবিত এনডিএ জোট ছাড়ার সম্ভাবনা খতাইয়া দেখিতেছেন। এই সুযোগ কাজে লাগাইয়া কংগ্রেসের উচিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ জোট নির্মাণে দ্রুত জনসংযোগ। |