এ যেন বিখ্যাত প্রতারক নটবরলালের ছোটখাটো সংস্করণ। সেই নটবরলাল, যিনি হেলায় বিক্রি করতেন তাজমহল, লালকেল্লা বা লোকসভা ভবন। প্রতারণার কলাকৌশল শিখতে যাঁর দ্বারস্থ হতেন দুঁদে পুলিশকর্তারাও।
কলকাতার ছোট সংস্করণ অবশ্য এখনই প্রতারণার জগতে সেই উচ্চতায় উঠতে পারেননি। তবে ঋণের টোপ দেখিয়ে যে কায়দায় দু’জনকে ঠকিয়েছে ওই যুবক, তাতে তাঁর মধ্যে নটবরলালের ছায়া দেখছেন গোয়েন্দারা।
ঠিক কী ঘটেছিল ঘটনাটি?
রাজু ধর নামে এক ব্যবসায়ী জানান, এ বছরের এপ্রিল মাসে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দিয়ে শৌভিক নামে এক যুবক তাঁকে ফোন করে। রাজুবাবুর নামে ওই বেসরকারি ব্যাঙ্ক তিন লক্ষ টাকা ঋণ মঞ্জুর করেছে বলে শৌভিক ফোনে তাঁকে জানায়। ঋণের জন্য আবেদন না করা সত্ত্বেও কী করে ব্যাঙ্ক তাঁর নামে ঋণ মঞ্জুর করল, তা খতিয়ে দেখেননি ওই ব্যবসায়ী। টাকার দরকার, তাই সাত-পাঁচ না ভেবেই তিনি ঋণ নিতে রাজি হয়ে যান। বরং ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে ৬-৭ লক্ষ করতে বলেন। এর পরেই ওই যুবক তাঁর বাড়িতে আসে। ঋণ দেওয়ার জন্য দরকারি কাগজপত্র দেখে ঋণ দেওয়ার চার পাতার একটি ফর্মও পূরণ করায় সে। ঋণের জন্য দরকার বলে রাজুবাবুর ইউকো ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টের দু’টি ‘ক্যানসেলড’ চেকও সই করিয়ে নিয়ে নেয়।
রাজুবাবু জানান, এর দু’তিন দিন পরে ওই প্রতিনিধি ফোন করে বলেন, তাঁর ইউকো ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট টাকা নেই। তাই তিনি যেন তাঁর অ্যাকাউন্টে কয়েক দিনের জন্য দু’লক্ষ টাকা জমা রাখেন। যুক্তি হিসেবে তাঁকে বলা হয়, ব্যাঙ্ক তাঁর নামে তিন লক্ষ টাকা ঋণ মঞ্জুর করেছিল। কিন্তু তিনি যেহেতু ৬-৭ লক্ষ টাকা ঋণ নেবেন, তাই ‘মার্জিন মানি’ হিসেবে আপাতত ক’দিনের জন্য তাঁর অ্যাকাউন্টে দু’লক্ষ টাকা থাকা দরকার।
সেই টাকা ব্যাঙ্কে রাখার পরেই প্রতারণার শিকার হন রাজুবাবু। তিনি বলেন,“ওই প্রতিনিধির কথা শুনে আমি অ্যাকাউন্টে দু’লক্ষ টাকা জমা রাখি এবং শৌভিক নামের ওই প্রতিনিধিকে ফোন করে টাকা জমা রাখার কথা জানিয়েও দিই। ভেবেছিলাম, ক’দিনের মধ্যেই ঋণের টাকা পাওয়ার খবর জানিয়ে ওই প্রতিনিধি আমাকে ফোন করবে। কিন্তু আর ফোন আসেনি।” তিনি জানান, এর পর থেকেই শৌভিক নামের ওই যুবককে তিনি বারবার ফোন করছিলেন। কিন্তু তার ফোনটি বন্ধ ছিল। এর পরেই রাজুবাবুর সন্দেহ হয়। ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখেন, তাঁর আশঙ্কাই সত্যি। ১ লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে চলে গিয়েছে গীতা মূর্তি নামে এক মহিলার অ্যাকাউন্টে। শৌভিককে দেওয়া তাঁর ‘ক্যানসেলড’ চেকের একটি ব্যবহার করে টাকা সরানো হয়েছে গীতাদেবীর ব্যাঙ্ক অফ বরোদার অ্যাকাউন্টে। এর পর রাজুবাবু হাজির হন ওই বেসরকারি ব্যাঙ্কেও। কিন্তু সেখান থেকে তাঁকে জানানো হয়, ঋণ বিভাগে শৌভিক নামে তাঁদের কোনও কর্মী নেই।
কী করে ‘ক্যানসেল’ করা চেক ব্যবহার করে টাকা সরানো হল?
পুলিশকর্তারা জানিয়েছেন, এ সব ক্ষেত্রে জালিয়াতির জন্য প্রতারকেরা দু’ধরনের পেন ব্যবহার করে। ব্যাঙ্কের সব কাগজপত্রগুলি একটি পেন দিয়ে পূরণ করানোর পরে, চেক ‘ক্যানসেল’ করার সময়ে ব্যবহার করা হয় একই রকম দেখতে আর একটি পেন। সেই পেনটিই হয় জালিয়াতির মূল অস্ত্র। এই পেনের কালি তুলে ফেলা যায়। তার জন্য ব্যবহার করা হয় এক ধরনের রিমুভার। পেন বদল করার সময় বার করার জন্য প্রতারকেরা কোনও না কোনও অজুহাতে আবেদনকারীকে কয়েক মিনিটের জন্য অন্যত্র পাঠায়। আর সেই ফাঁকেই পাল্টে ফেলে পেনটি। এ ক্ষেত্রেও এ রকমই কিছু ঘটেছে বলে পুলিশের ধারণা।
কিন্তু ক্যানসেলড চেক ব্যবহার করে যে অ্যাকাউন্টে টাকা সরানো হয়েছে, তার মালিকের নাম-ঠিকানা তো ওই ব্যাঙ্ক থেকে সহজেই জানা যায়। তা হলেই তো ধরা পড়ে যাবে প্রতারণা?
এ ক্ষেত্রেও প্রতারক এক মোক্ষম চাল চেলেছে।
তদন্তকারীরা রাজুবাবুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে জেনেছেন, তাঁর চেক জমা হয়েছে গীতা মূর্তি নামের এক মহিলার অ্যাকাউন্টে। তাঁর খোঁজ করতে গিয়ে গোয়েন্দারা জেনেছেন, গীতাদেবীকেও একই ভাবে ঋণের টোপ দিয়ে প্রতারিত করছে ওই প্রতারকই।
কী রকম?
ব্রহ্মপুরের বাসিন্দা পেশায় গৃহশিক্ষিকা মাঝবয়সী গীতাদেবী বলেন, “আমাকেও ওই ব্যাঙ্কের ঋণ মঞ্জুর হয়েছে বলে ফোন করেছিল শৌভিক নামের এক জন। ছেলের পড়াশোনার জন্য টাকার দরকার। তাই ঋণ নিতে রাজি হয়ে যাই।” তিনিও রাজু ধরের মতোই আর একটু বেশি ঋণ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অ্যাকাউন্টে বেশি টাকা ছিল না। গীতাদেবীর ক্ষমতাও ছিল না, ৫ লক্ষ টাকা ঋণ নেওয়ার জন্য অ্যাকাউন্টে দু’লক্ষ টাকা জমা দেওয়ার। কিন্তু প্রতারক গীতাদেবীকে আশ্বস্ত করে জানায়, ওই ‘মার্জিন মানি’র জন্য চিন্তা করতে হবে না। সে-ই তার চেনা এক ফাইন্যান্সরকে দিয়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য ওই টাকা গীতাদেবীর অ্যাকাউন্টে জমা করে দেবে। টাকা জমা পড়ার পরে ‘ভেরিফিকেশন’ হয়ে গেলে গীতাদেবী যেন টাকাটা তুলে শৌভিকের হাতে দিয়ে দেন। শৌভিকের কথা মতো তিনিও ব্যাঙ্কের যাবতীয় কাগজপত্র পূরণ করেন। দেন একটি ‘ক্যানসেলড’ আর পাঁচটি ‘ব্ল্যাঙ্ক’ চেক।
এর ২০ দিনের মাথায় গীতাদেবীর অ্যাকাউন্টে টাকা চলে আসে। গোয়েন্দারা তদন্ত করে দেখেছেন, রাজু ধরের চেকটিই ওই সময়ে জমা করা হয় গীতাদেবীর অ্যাকাউন্টে। গীতাদেবীও ভাবেন, শৌভিকই ফাইনান্সরকে দিয়ে চেকের মাধ্যমে টাকা জমা করে দিয়েছেন। এর পরে যাচাইয়ের কাজ হয়ে গিয়েছে বলে গীতাদেবীকে ব্যাঙ্ক অফ বরোদার ব্রহ্মপুর শাখা থেকে ‘সেল্ফ’ চেক দিয়ে পুরো টাকাটা তুলে দিতে বলে শৌভিক। তিনিও বিশ্বাস করে নিজে ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা তুলে দিয়ে তা দিয়ে দেন শৌভিককে। এ ভাবেই ব্যাঙ্কে না গিয়েই পুরো টাকাটাই হাতিয়ে নিয়েছে ওই প্রতারক।
গোয়েন্দারা গীতাদেবীকে জেরা করতে গিয়ে পুরো বিষয়টি জানতে পারেন। এ মধ্যে অবশ্য প্রতারিত গীতাদেবীও বাঁশদ্রোণী থানায় ওই প্রতারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। ব্যাঙ্ক অফ বরোদার ব্রহ্মপুর শাখার ম্যানেজারও বলেন, “গীতাদেবীকে বহু দিন ধরেই চিনি। প্রতারককে ব্ল্যাঙ্ক চেক দেওয়ার পরে সে উধাও হয়ে যায়। এর পরেই উনি সব বুঝতে পেরে আমার কাছে এসে ওই চেকগুলির পেমেন্ট বন্ধ করান।” পুলিশও জানিয়েছে, দু’জনকেই একই ব্যক্তি প্রতারণা করেছে। কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়ার মতো কোনও সূত্র ছেড়ে যায়নি। এমন নিখুঁত প্রতারণা খুবই কম দেখা যায় বলেই গোয়েন্দাদের মনে পড়ে যাচ্ছে বিখ্যাত প্রতারক নটবরলালের কথা।
|
আসল নাম মিথিলেশকুমার শ্রীবাস্তব। নটবরলাল নামেই কিংবদন্তী। এই শিল্পী-প্রতারকের চালে ঘায়েল হয়েছেন বিড়লা-অম্বানিদের মতো শিল্পপতিরাও। লালকেল্লা, রাষ্ট্রপতি ভবন বা সংসদ-ভবন হেলায়
বেচেছেন বার বার। সই জাল করেছেন খোদ রাষ্ট্রপতিরও।
অমিতাভ-অভিনীত ‘মিস্টার নটবরলাল’-এর প্রেরণাও তিনিই। ১৯৯৬ সালে ৮৪ বছর বয়সে হুইলচেয়ার-বন্দি দশায় শেষ বার পুলিশকে ঘোল খাওয়ান। মৃত্যুর পরে সিওয়ানের বাংড়া গ্রামের জন্মস্থানে মূর্তি বসেছে এই প্রতারক শিরোমনির। |