অবশেষে একটু হলেও এল কাঙ্খিত পরিবর্তন। ঘোরতর নেতিবাচক মনোভাব বদলে গেল ইতিবাচক সায়-এ।
পাল্স পোলিও টিকাকরণে অনীহার ব্যাপারে এতদিন কুখ্যাত ছিল কলকাতার ৭ ও ১৫ নম্বর বরো। মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনরিচ, ট্যাংরা, খিদিরপুর, তিলজলার একটা বড় অংশ ছিল এর মধ্যে। প্রশাসনকে চমকে দিয়ে গত কয়েক মাসে ওই দুই বরোয় পাল্স পোলিও সম্পর্কে প্রতিরোধ কমেছে। কিছুটা হলেও কমেছে পোলিও না-খাওয়ানো পরিবারের সংখ্যা। আর একেই বড় জয় হিসাবে দেখছে স্বাস্থ্য দফতরের টিকাকরণ দফতর ও কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগ।
জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলে তিন বার পাল্স পোলিও কর্মসূচি হয়। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৫ নম্বর বরোয় তিন মাসে ১২০টি পরিবার সুদীর্ঘ অনীহা ছেড়ে শিশুকে পাল্স পোলিও খাওয়াতে রাজি হয়। ৭ নম্বর বরোয় দীর্ঘদিনের প্রতিরোধ ছেড়ে পাল্স পোলিও গ্রহণ করেছে ৪০টি পরিবার। সাম্প্রতিক অতীতে ওই দুই বরোয় পাল্স পোলিও বিষয়ে একসঙ্গে এত পরিবারের রাজি হওয়ার নজির নেই। |
পুরসভার হিসেব বলছে, ১৫ নম্বর বরোয় জানুয়ারি মাসের রাউন্ডে ১৩১২টি পরিবার শিশুকে পোলিও খাওয়াতে বাধা দেয়। ফেব্রুয়ারিতে সেই প্রতিরোধী পরিবারের সংখ্যা কমে হয় ১১৯৮। এপ্রিলে আরও ৪টি পরিবার রাজি হওয়ায় এখন সেই সংখ্যা ১১৯৪। জানুয়ারি রাউন্ডে ৭ নম্বর বরোয় পোলিও খাওয়াতে বাধা দিয়েছিল ৮২টি পরিবার, ফেব্রুয়ারিতে সেই সংখ্যা কমে হয় ৫৮, এপ্রিলে আরও কমে হয় ৪২টি।
রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কমিশনার পার্থসারথি চৌধুরী জানান, বদল হঠাৎ হয়নি। প্রক্রিয়াটা ভিতরে-ভিতরে চলছিল। নভেম্বর থেকে এই অঞ্চলগুলোর পাড়ায়-পাড়ায় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দফতরের স্থানীয় প্রতিনিধিদের দিয়ে ‘অভিযোগ-বৈঠক’ আয়োজন করা হচ্ছিল। সেখানে স্থানীয়রা নানা অসুবিধা জানাতে পারছিলেন। সুরাহা বাতলানোর পাশাপাশি শিশুদের পাল্স পোলিও খাওয়ানোর অনুরোধ জানানো হচ্ছিল।
পার্থবাবুর কথায়, “বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পোলিও খাওয়ানো বাতিলের কারণ হিসেবে ওই দুই বরোর মানুষ নানা অপ্রাপ্তির কথা বলতেন। যেমন রাস্তা ঠিক নেই, নর্দমা সারাই হচ্ছে না, জল জমছে, জননী সুরক্ষার টাকা মিলছে না, খাবার জল নেই ইত্যাদি। দেখলাম সমস্যাগুলি শুনলে ওঁরাও কথা শুনে বাচ্চাদের পোলিও খাওয়াতে আনছেন।”
১৫ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান রঞ্জিত শীল জানান, কয়েক মাস ধরে স্থানীয় চিকিৎসকদের দিয়ে বাড়ি-বাড়ি প্রচার চালানো হয়েছে, পোলিও খাওয়ানো হয়েছে। এতে অনেক কাজ হয়েছে। বরো ৭-এর চেয়ারপার্সন সুস্মিতা ভট্টাচার্য আবার মনে করেন, শিক্ষার প্রসার আর গণমাধ্যম অনেকটা ভূমিকা নিয়েছে।
৭ ও ১৫ নম্বর বরোর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেল, মানসিকতা সত্যিই বদলাচ্ছে। গার্ডেনরিচে ৪৭/এ/২ পাহাড়পুর রোডের বাসিন্দা বছর তিরিশের রাজ রায় জানালেন, তাঁদের পরিবারে কাউকে পাল্স পোলিও খাওয়ানো হত না। ধারণা ছিল, এই ওষুধ খারাপ, খেলে আরও বেশি পোলিও হবে। তিনি নিজে না খেলেও ২ বছরের ছেলে অরিহন্তকে এপ্রিল থেকে খাওয়াচ্ছেন। ফতেপুর ভিলেজ রোডে ‘জে-২৯’ ঠিকানায় ২৩টি টালির ছাদের ঘরে ঘেঁষাঘেঁষি করে ২৩টি পরিবারের বাস। প্রত্যেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত। সেখানকার বাসিন্দা রুনা বিবি তাঁর ৩ বছরের ছেলে রেজাউলকে ফেব্রুয়ারি থেকে পোলিও খাওয়াচ্ছেন। বললেন, “ভাবতাম পাল্স পোলিও খেলে ছেলে নপুংসক হবে।” আফসানা খাতুনের দুই ছেলে ৫ বছরের মহম্মদ আলতামস ও ৩ বছরের মহম্মদ শাহনওয়াজও পাল্স পোলিও খাচ্ছে জানুয়ারি থেকে। আফসানার কথায়, “বাড়িতে সবাই বলত, আমরা গরিব, সরকার আমাদের জন্য কী করে যে তার কথা শুনে বাচ্চাকে পোলিও খাওয়াব? কিন্তু টিভিতে দেখেছি, পাল্স পোলিও না খেলে আমার ছেলেগুলোর পা সরু হয়ে যাবে। ওরা কাজ করতে পারবে না। ওদের আব্বুর সঙ্গে ঝগড়া করে জোর করে পাল্স পোলিও খাইয়ে এনেছি।” |