রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ছিলই, এখন দ্রুত লাগামছাড়া
সে দিনটা ছিল পুরভোট। উত্তর ব্যারাকপুর পুরসভা এলাকার একটি স্কুলের দো-তলায় বুথ জ্যাম করে ছাপ্পা চলছিল। ছবি তুলতে গিয়ে আচমকা আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন এক দল সাংবাদিক ও চিত্রগ্রাহক। সিপিএমের স্থানীয় বা জেলা নেতারা কেউ বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি।
আট বছর পরে সেই এলাকারই কাছাকাছি ব্যারাকপুরে মারের মুখে পড়েছেন আস্তিক চট্টোপাধ্যায়, বরুণ সেনগুপ্তেরা। তৃণমূলের কোনও নেতা তাঁদের উদ্ধার করতে যাননি।
গুন্ডারাজের ট্র্যাডিশন বদলায়নি! যে যখন ক্ষমতায়, দুর্বৃ্ত্তদের কাজে লাগিয়ে তারাই চেষ্টা করেছে এলাকায় দখলদারি কায়েম রাখার। পরিণতিতে কখনও নন্দীগ্রামে আক্রান্ত হয়েছে সংবাদমাধ্যম, কখনও যাদবপুরে প্রহৃত হয়েছেন ক্যামেরাম্যান, কখনও গার্ডেনরিচে গুলি খেয়েছেন পুলিশ অফিসার। কিছু দিন হইচই। নেতারা বিবৃতি দিয়েছেন, নিন্দা করেছেন। গুন্ডারাজে তবু লাগাম পড়েনি!
শিল্পাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক কারণেই সমাজবিরোধীদের তাণ্ডব ও অপরাধ-প্রবণতা তুলনামূলক ভাবে বেশি। গঙ্গার পূর্ব পাড়ে ব্যারাকপুর, পশ্চিম পাড়ে হুগলি, হাওড়া এবং আরও দূরের দুর্গাপুর-আসানসোল, সর্বত্রই একই চিত্র। আসানসোলের শিল্পাঞ্চলে যেমন রবিবারই সকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হয়েছেন এক প্রাক্তন বিধায়ক। শিল্পাঞ্চলের মানুষ তাঁদের অভিজ্ঞতায় দেখছেন, এলাকায় দাপট রাখার জন্য আগে কংগ্রেস এবং সিপিএম নেতারা সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয় দিয়েছেন। এখন সেই জুতোয় পা গলিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব!
কলকাতা পুরসভার এক প্রবীণ প্রাক্তন কাউন্সিলরের কথায়, “রাজনীতিতে গুন্ডা বহু বছর আগেও ছিল। সেই ১৯৫৩ সালের জুলাইয়ে কলকাতায় ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলন হয়েছিল। সাদা পোশাকের পুলিশের সঙ্গেই গুন্ডারা জড়ো হয়ে আন্দোলনকারীদের পিটিয়েছিল! মার খেয়েছিলেন সাংবাদিকেরাও। এখন গুন্ডামি সংগঠিত হয়েছে!”
কেমন সংগঠিত, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলই অন্যতম ভুক্তভোগী। এলাকার এক ছোট ব্যবসায়ীর কথায়, “বাহাত্তর সালে কংগ্রেস-নকশালদের হাত ধরে গুন্ডারাজের শুরু। টিটাগড়, জগদ্দল, কাঁকিনাড়া, হাজিনগর থেকে মস্তানেরা আসে, সকলে জানে! রাস্তা তৈরি, প্রোমোটারি, গঙ্গার খাদ থেকে বালি তোলা সবেতে মস্তানি আর তোলাবাজি। কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই!”
তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য মানতে নারাজ যে, ব্যারাকপুর বা অন্যত্র তাঁরা গুন্ডারাজকে মদত দিচ্ছেন। তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “দলের বর্ধিত সাধারণ সভা থেকে শুরু করে সর্বত্র আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সতর্ক করে দিয়েছেন, অসামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকা চলবে না। তা সত্ত্বেও যারা গুন্ডামি করছে, তাদের হাতে তৃণমূলের ঝান্ডা থাকতে পারে না! ঝান্ডা তাদের হাতে রাখা যাবে না!” শাসক দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের দাবি, “দু-একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া রাজ্যে কোথাও অশান্তি নেই। আমাদের দলে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বও নেই।” একই সঙ্গে পার্থবাবু স্মরণ করাচ্ছেন, অন্য দল থেকে কেউ এলে তাকে নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। রাজ্য স্তরের নেতৃত্বের অনুমোদন নিতে হবে।
কিন্তু এই সাবধান-বাণীতে কি গুন্ডারাজ আটকাচ্ছে? ব্যারাকপুরের ঘটনাতেই মূল অভিযুক্ত যে শিবু যাদব, এক কালে সিপিএম এবং পরে কংগ্রেসের হাত ঘুরে সর্বশেষ আশ্রয় হয়েছিল তৃণমূল। শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কখনও বলছেন তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে, কখনও দাবি তাকে দলে নেওয়াই হয়নি! যদিও ব্যারাকপুরের মানুষ দেখেছেন, ২০ মে কোন দলের সাংসদ ও বিধায়ক হাজির থেকে শিবুর হাতে দলের পতাকা তুলে দেন! শিল্পাঞ্চল বালির দিকে তাকালেও ছবি একই। বাম জমানায় গুন্ডামির আতঙ্কে যাঁদের দিন কাটত, তাঁরাই এখন দুর্বৃত্তরাজ দেখছেন অন্য দলের ছত্রচ্ছায়ায়! সদ্য উপনির্বাচনেও দেখেছেন।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলছেন, “আমাদের আমলে সমাজবিরোধীরা ছিল না, এটা বলতে পারব না! কিন্তু তারাই শুধু যা খুশি করে বেড়াবে, পাড়ার লোক মাথা নিচু করে থাকবে এই রকম ছিল না!” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলছেন, “কোথাও কিছু হলেই আগে কী হয়েছিল, তা-ই দিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়ার একটা তত্ত্ব চালু আছে। বদলা নয়, বদল চাই স্লোগান দিয়ে যারা ক্ষমতায় এসেছিল, তারা দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন করে দেখাক!”
সাড়ে তিন দশকের বাম জমানায় কোথাও তড়িৎ তোপদার, কোথাও অমিতাভ নন্দী, কোথাও লক্ষ্মণ শেঠদের বিরুদ্ধে পেশিশক্তি ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন বিরোধীরা। যে ব্যারাকপুরে এখন তৃণমূল কাঠগড়ায়, সেই এলাকাই প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তীর (হাতকাটা দিলীপ বা পিনাকীদের সঙ্গে যাঁর নাম জড়িয়েছে বহু বার) গোষ্ঠীর সঙ্গে নন্দী-গোষ্ঠীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দেখেছে। এখন দেখছে অর্জুন সিংহদের দাপট! প্রাক্তন সাংসদ তড়িৎবাবু অবশ্য বলছেন, “এখানে যে মস্তানেরা আসে, তারা পরম্পরাগত ভাবে বাম-বিরোধী! সমাজবিরোধীরা আগেও ছিল। কিন্তু আসল কথা নিয়ন্ত্রণ।” ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলেরই অন্তর্গত জগদ্দলের তৃণমূল বিধায়ক পরশ দত্ত বলছেন, “রাজনীতিতে দুর্বৃত্তেরা আগেই ঢুকে পড়েছে, এ কথা ঠিক। চেষ্টা করছি ঠেকাতে। মিছিলে ঝান্ডা নিয়ে কেউ ঢুকে পড়লে কী ভাবে আটকাব?”
ভুক্তভোগী জনতার মতে, ব্যারাকপুরে দীনেশ ত্রিবেদী, দমদমে সৌগত রায় বা জগদ্দলে পরশবাবুরা সাংসদ বা বিধায়ক হওয়ায় বাহুবলীদের দিয়ে এলাকা চালানোর প্রবণতা বেড়েছে। কারণ, ওই জনপ্রতিনিধিরা কেউই নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দা নন। ফলে, নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে অস্বচ্ছ লোকজনের হাতে। দীনেশের দাবি, তিনি বিধায়ক ও পুরপ্রধানদের মাধ্যমে কাজ করেন। মস্তান-সংস্রবের প্রশ্নই নেই। পরশবাবুর দাবি, সপ্তাহে দিন তিনেক এলাকায় যান। খবরও রাখেন। কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে কি?
ভুক্তভোগীরা বলছেন, হচ্ছে না! উত্তর ২৪ পরগনা জেলারই এক স্কুলশিক্ষকের কথায়, “আগে মজিদ মাস্টারের কথা শুনতাম। এখন কত মাস্টার!” তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতাও কবুল করছেন, “কংগ্রেস শতবর্ষ অতিক্রান্ত দল। কিন্তু গুন্ডারাজ এনেছিল তারাই। সিপিএম তা তিন গুণ বাড়ায়। তাদের দলও প্রায় অর্ধ-শতবর্ষ কাটাল। তৃণমূলের বয়স সবে ১৫। একই পথে চললে তারাও অত দিন কাটাতে পারবে বলে কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন! কিন্তু তা হবে না।”
অপেক্ষায় থাকা ছাড়া বঙ্গবাসীর আর গত্যন্তর কী?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.