মনোনয়ন দাখিল শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জেলা জুড়ে হানাহানির বিরাম নেই। মারধর, দোকান বা পার্টি অফিস পোড়ানোর মতো ঘটনা নিয়ে শুক্রবারও দিনভর অশান্তি হল নানা এলাকায়।
কেতুগ্রাম ১ ব্লকের পালটিয়া পঞ্চায়েতে প্রহৃত হলেন সিপিএমের এক মহিলা প্রার্থী ও তাঁর স্বামী-শাশুড়ি। পালটিয়ার বাসিন্দা সন্তোষী মাঝি এ বার পাশের গ্রাম তিলডাঙা থেকে প্রার্থী হয়েছেন। ওই পঞ্চায়েতের ১৩টি আসনের মধ্যে মাত্র তিনটিতে প্রার্থী দিতে পেরেছে সিপিএম। দলীয় নেতৃত্বের অভিযোগ, শুক্রবার সন্ধ্যায় তৃণমূলের লোকজন সন্তোষীদেবীর বাড়িতে গিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিতে থাকেন। তিনি রাজি না হওয়ায় তাঁকে মারধর করা হয়। বাঁচাতে গিয়ে প্রহৃত হন তাঁর স্বামী কালোসোনাবাবু ও শাশুড়ি বোদনদেবী। তাঁদের তিন জনকেই কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। সন্তোষীদেবীর অভিযোগ, “প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। তাতে মাথা নত না করার জন্যই মার খেতে হল।” তৃণমূলের কেতুগ্রাম ১ ব্লক সাধারণ সম্পাদক জাহির শেখের যদিও দাবি, “পারিবারিক বিবাদের জেরেই এই ঘটনা। এর মধ্যে রাজনীতির কোনও ব্যাপার নেই।” পুলিশেরও বক্তব্য, একটি পুকুরে মাছ ফেলাকে কেন্দ্র করে এই গোলমাল হয়েছে বলে তাদের কাছে খবর রয়েছে।
এ দিন কাঁকসার করনডাঙা আদিবাসী পাড়ায় মারধর করা হয় দুই তৃণমূল কর্মীকে। অভিযুক্ত সিপিএম। এক জনকে লক্ষ করে গুলিও ছোড়া হয় বলে অভিযোগ। যদিও তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এ দিনই রায়নায় ভস্মীভূত হয়েছে তৃণমূলের একটি পার্টি অফিস। মঙ্গলকোটে এক কংগ্রেস প্রার্থীর দোকান পোড়ানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। |
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এ দিন সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ তৃণমূল কর্মী বিকাশ রায় ও সুকুমার রুইদাস করনডাঙা আদিবাসী পাড়ায় প্রচারে যান। দলের জেলা (শিল্পাঞ্চল) সম্পাদক দেবদাস বক্সী অভিযোগ করেন, সেই সময়ে স্থানীয় সিপিএম নেতা স্বপন দত্তের নেতৃত্বে এক দল লোক বিকাশবাবু এবং সুকুমারবাবুকে ঘিরে ধরে মারধর করে। বিকাশবাবুকে লক্ষ করে গুলিও ছোড়া হয় বলে অভিযোগ। যদিও সেটি তাঁর গায়ে লাগেনি। দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তির পরে বিকাশবাবু বলেন, “আমাকে যথেচ্ছ পেটানো হয়। সারা গায়ে ব্যথা হয়ে গিয়েছে।” হাসপাতালে তাঁকে দেখতে যান আইএনটিটিইউসি-র জেলা সভাপতি প্রভাত চট্টোপাধ্যায়। চোট তেমন গুরুতর না হওয়ায় বিকাশবাবুর ঘণ্টা তিনেক পরে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।তৃণমূল নেতা দেবদাসবাবুর দাবি, “পঞ্চায়েত ভোটে সিপিএমের হার নিশ্চিত। তাই তারা সন্ত্রাসের আশ্রয় নিচ্ছে।” তিনি জানান, কাঁকসা থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।
সিপিএম নেতারা যদিও অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা কাঁকসার প্রাক্তন জোনাল সম্পাদক বীরেশ্বর মণ্ডল দাবি করেন, গোপালপুর পঞ্চায়েতে তাঁদের প্রার্থী আরতি মাড্ডির বাড়ি গিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেন বিকাশবাবু। শুক্রবার সকালে এক সঙ্গীকে নিয়ে তিনি ফের সেখানে গেলে পাড়ার লোকজন তাড়া করেন। বীরেশ্বরবাবুর দাবি, “এর পরে তারা রটিয়ে দেয়, তাদের নাকি গুলি করা হয়েছে।” তাঁর পাল্টা অভিযোগ, “মনোনয়ন তোলার জন্য চাপ দিতে আমাদের প্রার্থী, প্রস্তাবকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিচ্ছে সিপিএম। কারখানায় সিটু সমর্থকদেরও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের এমন অভিযোগ কি বিশ্বাসযোগ্য?”
এক কংগ্রেস প্রার্থীর দোকানে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে মঙ্গলকোটে। শুক্রবার সকালে পথিক চৌধুরী নামে ওই প্রার্থী মঙ্গলকোট থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। মঙ্গলকোটের ভাল্যগ্রাম পঞ্চায়েতের বেলগ্রামের বাসিন্দা পথিকবাবু কংগ্রেসের হয়ে মনোনয়ন দাখিল করেছেন। কাটোয়ার ডাকবাংলো-নতুনহাট রাস্তার বেলগ্রাম বাসস্টপ মোড়ে পথিকবাবুর চায়ের দোকান রয়েছে। মাটির দেওয়াল ও খড়ের চালের দোকানটিতে বৃহস্পতিবার রাতে কেউ আগুন লাগায় বলে তাঁর অভিযোগ।
কংগ্রেস নেতৃত্বের ধারণা, এর পিছনে তৃণমূলের হাত রয়েছে। দলের মঙ্গলকোট ব্লক সভাপতি দীনু পালের অভিযোগ, “পূর্ব মঙ্গলকোটের ভাল্যগ্রাম পঞ্চায়েতটি আমাদের দখলে রয়েছে। তৃণমূল অনাস্থা এনেও আমাদের হারাতে পারেনি। এখন ভোটের আগে প্রার্থীর দোকান পুড়িয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে চাইছে তৃণমূল।” তৃণমূল যদিও তা মানতে চায়নি। দলের ব্লক সভাপতি অপূর্ব চৌধুরীর পাল্টা অভিযোগ, “ওই পঞ্চায়েত এলাকায় কংগ্রেস আশ্রিত দুষ্কৃতীরা শাসন করে। তারাই দোকানে আগুন লাগিয়ে আমাদের বদনাম করতে চাইছে।”
রায়নার নাড়ুগ্রামে বৃহস্পতিবার রাতে ভস্মীভূত হয়েছে তৃণমূলের একটি অফিসও। কে বা কারা এর পিছনে রয়েছে, পুলিশ সে ব্যাপারে আঁধারে। স্থানীয় তৃণমূল নেতা অশোক সাঁতরা অবশ্য অভিযোগ করেন, এই ঘটনায় সিপিএমের হাত রয়েছে। তাঁর দাবি, “গত দু’টি পঞ্চায়েত ভোটের পরে এ বারই প্রথম সমস্ত আসনে প্রার্থী দিয়েছি আমরা। তাতে ক্ষুব্ধ সিপিএমের লোকেরা আমাদের লোকেদের হুমকি দিচ্ছিল। ভয় দেখাতেই আমাদের অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।” বেশ কয়েকটি চেয়ার, নগদ টাকা পুড়ে গিয়েছে বলে তাঁর দাবি। তবে সিপিএমের পাল্টা দাবি, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই এমন ঘটেছে।
বৃহস্পতিবার রাতে মাধবডিহির বৈদ্যপুর থেকে এক সিপিএম সমর্থককে আগ্নেয়াস্ত্র-সহ গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাঁর নাম অসিত রায়। অন্তত দু’টি মামলায় তাঁকে পুলিশ খুঁজছিল। কালনায় এক ব্যক্তিকে ভয় দেখানোর অভিযোগ পেয়ে পুলিশ নাড়ু মল্লিক নামে এক সিপিএম সমর্থককে গ্রেফতার করেছে। তাঁর কাছ থেকে চারটি তাজা বোমাও উদ্ধার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানায়।
বুধবার সন্ধ্যা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত বুদবুদের দেবশালা পঞ্চায়েতের বিলাসপুর গ্রামে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষ হয়। সেই ঘটনায় তৃণমূলের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তিন জনকে গ্রেফতার করেছে। শুক্রবার আর নতুন করে কোনও অশান্তি বাধেনি বলে পুলিশ জানিয়েছে। পঞ্চায়েতের ভোটের প্রক্রিয়া শুরুর পরে জেলার গ্রামীণ এলাকা থেকে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র মিলেছে বলে জানান পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা। তিনি বলেন, “৫ জুন পর্যন্ত ১৬টি আগ্নয়াস্ত্র, ২৯টি গুলি ও ২৮টি বোমা উদ্ধার হয়েছে।”
পাণ্ডবেশ্বরে পঞ্চায়েত সমিতির এক সিপিএম প্রার্থীর স্বামীকে মারধর এবং বাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ডালুরবাধের বাসিন্দা কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় পুলিশে অভিযোগ করেন, শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে চার জন চড়াও হয়। তিনি ভয়ে একটি ঘরে ঢুকে পড়েন। তাঁর স্বামী বিজয়বাবুকে সামনে পেয়ে বেধড়ক মারধর করে ও জিনিসপত্র ভেঙে চলে যায় ওই দুষ্কৃতীরা। তৃণমূলের পাণ্ডবেশ্বর ব্লক সভাপতি নরেন চক্রবর্তী বলেন, “হার নিশ্চিত জেনে ওরা মিথ্যা অপপ্রচার করছে।” পুলিশ জানিয়েছে, তদন্ত শুরু হয়েছে।
|
বাতিল ৭৩ প্রার্থীর মনোনয়ন
নিজস্ব সংবাদদাতা • বর্ধমান |
ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের মনোনয়নপত্র পরীক্ষার পরে প্রাথমিক ভাবে জেলা পরিষদের তিন জন, পঞ্চায়েত সমিতির সাত জন ও পঞ্চায়েতের ৬৩ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হল। জেলাশাসক তথা জেলা নির্বাচন আধিকারিক ওঙ্কার সিংহ মিনা বলেন, “প্রার্থী হওয়ার জন্য ন্যূনতম বয়স না হওয়া, অন্য এলাকার ভোটার হওয়া বা নিজেই প্রস্তাবক হয়ে যাওয়া বা জাতিগত শংসাপত্র দাখিল না করতে পারার মতো নানা কারণে এই ৭৩ জনের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।” |