|
|
|
|
|
|
|
পড়াশোনা... |
|
সিলেবাসে নেই |
আলেকজান্ডার দুমা বাদ। জুল ভার্ন বাতিল। হেমিংওয়ে থেকে স্টিভেনসন, নেই ওঁরাও।
জেন ওয়াইয়ের বুকলিস্টে তবে আছেন কারা? খোঁজ নিলেন শর্মিষ্ঠা গোস্বামী |
কালো-সাদা মলাটের বইটা কাল থেকে বেশ মন দিয়েই পড়ছে অর্চি। পড়ার বইয়ের বাইরে ছেলেকে আর কিছু তো কখনও এত মন দিয়ে পড়তে দেখেনি তৃণা।
অর্চি স্কুলে বেরিয়ে যাওয়ার পর একটু রিল্যাক্স করবে ভেবে বইটা হাতে নিল তৃণা। কয়েক পাতা পড়েই সোজা হয়ে বসল। সতেরো বছরের ছেলে আজকাল খালি এই সব পড়ছে নাকি! এ তো ক্রিশ্চিয়ান গ্রে আর অ্যানাস্তাশিয়া স্টিল নামে দু’জন ছেলেমেয়ের বিছানা দৃশ্যের রুদ্ধশ্বাস বর্ণনা! পাতায় পাতায় চূড়ান্ত যৌনতা। একটু নেট সার্চ করে জানা গেল ‘ফিফটি শেডস অফ গ্রে’ নামে বেস্ট সেলার এই বইটার আরও দু’টো সিকুয়েল বেরিয়ে গিয়েছে। সবই বেস্ট সেলার লিস্টে।
নিজের ছোটবেলায় এমন কোনও বই পড়ছে বাবা-মা জানতে পারলে কী হত, ভাবতেও পারে না তৃণা। কিন্তু এখন সতেরো বছর আদৌ কোনও ছোটবেলা নয়। এ নিয়ে কিছু বলতে গেলে অর্চি বলবে, ‘‘কাম অন মা, অ্যাম নট আ চাইল্ড এনি মোর।” বলা যায় না, হয়তো মা-র সঙ্গে এ নিয়ে অ্যাকাডেমিক ডিসকাশনও শুরু করে দিতে পারে।
নাহ্, কিছু বলার দরকার নেই। তবে ফিফটি শেডস দেখে সিডনি শেলডনের বইগুলোর কথা মনে পড়ে গেল তৃণার। এখনও আছে বুকশেল্ফে। শেলডনের থ্রিলারের অন্তরঙ্গ যৌনতা কি তারাও লুকিয়ে এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলেনি? শেলডনের ‘রেজ অফ এঞ্জেলস’-এর জেনিফার পার্কার আর অ্যাডাম ওয়ার্নার-এর শরীরী প্রেমের গ্রাফিক বর্ণনা তো বারবার পড়ত তারাও।
ইংরেজিতে লেখা বা অনূদিত ক্লাসিক সাহিত্য আর তেমন টানে না কিশোর-তরুণ, অর্থাত্ ইয়ং অ্যাডাল্টদের। আলেকজান্ডার দুমা, রবার্ট লুই স্টিভেনসন, জুল ভার্ন নানা রকম সংস্করণ পাওয়া গেলেও পড়ুয়ার সংখ্যা কমছে। সে কথা জানিয়েছেন শহরের দুটি জনপ্রিয় বইয়ের আউটলেটের প্রতিনিধিরা।
এই পরিবর্তন প্রসঙ্গে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, “দুঃখ করে লাভ নেই। সবেরই পরিবর্তন হয়। এ-ও তাই। ওরা যা পড়ছে পড়ুক। তবে একটু-আধটু ক্লাসিকও পড়া দরকার। ছোটরা যদি ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’, ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অব নোতরদাম’ কিংবা ‘টোয়েন্টি থাউজান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’ না পড়ে, তবে কেমন যেন একটু অসম্পূর্ণ লাগে আমাদের কাছে।” |
|
প্রেসিডেন্সির ছাত্র ঋত্বিক গোস্বামীর কথায়, ক্যাম্পাস রোম্যান্স, বিচ্ছেদ, সেক্স, রাজনীতি, কেরিয়ার এই সব বিষয় নিয়ে এখনকার ইংরেজিতে মুচমুচে ফিকশন বেশি পছন্দ টিন-এজার আর ইয়ং অ্যাডাল্টদের।
বইয়ের নাম শুনেই তো কিনে ফেলে কলেজ পড়ুয়ারা। যেমন দুর্জয় দত্তের ‘অফ কোর্স আই লাভ ইউ,’ ‘ইফ ইটস নট ফরএভার, ইটস নট লাভ’, ‘ইউ ওয়্যার মাই ক্রাশ..’ ইত্যাদি। দামও কম। ৮০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে। পকেটমানি থেকেই কিনে ফেলা যায় সহজে। তা ছাড়া টিভি, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং, ব্লগ-এর যুগে বসে সময় নিয়ে ক্লাসিকস্ পড়ার ধৈর্য কোথায়!
রবীন্দ্র সিংহের ‘আই টু হ্যাড আ লাভ স্টোরি’ ‘ক্যান লাভ হ্যাপেন টোয়াইস?’ কিংবা সিসিলিয়া আহার্ন-য়ের ‘হোয়্যার রেনবোস এন্ড’, ‘ইফ ইউ কুড সি মি নাও’ বা ‘পিএস, আই লাভ ইউ।’ পাশাপাশি, আমাদের চেতন ভগত তো আছেনই। সাহিত্য মূল্য নিয়ে বিশেষ ভাবার সময় কারও নেই। পড়তে ভাল লাগলেই হল।
সদ্য আইসিএসই উত্তীর্ণ মেঘালী মিত্র সিসিলিয়া আহার্নের ভক্ত। ও ঠিক এমনই কথা বলছিল, “আমার চারপাশের সময়, লোকজন, তাঁদের দুঃখ-ভালবাসার সঙ্গে ওঁর গল্পগুলো খুব মেলাতে পারি। তা ছাড়া আর একটা ব্যাপারও আছে।” কী সেটা? “‘পিএস আই লাভ ইউ’টাই দেখুন। স্বামী মারা যাওয়ার পর স্ত্রী তাঁর তিরিশতম জন্মদিনে একটা পার্সেল পেলেন। তাতে তাঁর স্বামীরই লেখা দশটা চিঠি। মৃত্যু আসন্ন জেনে তিনি স্ত্রীকে লিখে গিয়েছিলেন। প্রতি মাসে স্ত্রী একটা করে চিঠি পড়তেন। শেষ চিঠিটায় লেখা ছিল, আমি চলে গেলাম তো কী হয়েছে! তুমি আবার কাউকে ভালবেসো। জীবনকে, ভালবাসাকে এ ভাবে বর্ণনা করার মধ্যে একটা স্পিরিট আছে। এই স্পিরিটটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
অর্থনীতির ছাত্রী প্রিয়াঙ্কা পাত্রর বক্তব্য, এখনকার প্রজন্ম ইংরেজিতে সাবলীল, তারা অনেক সময়েই নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলে। মোবাইলে টেক্সট করার সময়ও ভাষাটা ইংরেজি। তারা চায় এমন কিছু যা সহজে বুঝতে পারে। তা ছাড়া ক্লাসিক সাহিত্যে যে সময়ের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো ওরা তেমন রিলেট করতে পারে না। অচেনা পৃথিবী, অদেখা সম্পর্কে ওদের উত্সাহ কম। তাই আগ্রহও তেমন তৈরি হয় না। ওদের চাওয়া-পাওয়ার জগতেও তো একটা ব্যাপক বদল এসেছে অন্তত দু-আড়াই দশকে।
সেক্টর ফাইভের সিসিডিতে বসে চার জনের যে দলটা আড্ডা মারছিল, তাদের এক জন হসপিটাল ম্যানেজমেন্টের ছাত্রী শাইনি বন্দ্যোপাধ্যায়। সে জানাল, তার ফেভারিট স্টেফানি মেয়ারের ‘টোয়াইলাইট সিরিজ’। অচেনা পৃথিবীর প্রাসঙ্গিকতা যদি না থাকে, তা হলে ভ্যাম্পায়ার ফ্যান্টাসির প্রাসঙ্গিকতাই বা কী? শাইনির বক্তব্য, “টোয়াইলাইটে আই জাস্ট লাভ দ্য কাপল, ইসাবেলা আর এডওয়ার্ড। অ্যান্ড হোয়াট আ রোম্যান্স!”
আলোচনাটা সঙ্গে সঙ্গে ‘টোয়াইলাইট সিরিজ’-এর সিনেমার দিকে চলে গেল, যেখানে রবার্ট প্যাটিনসন আর ক্রিশ্চিয়ান স্টুয়ার্ট বা ‘রবস্টেন’ বইয়ের চরিত্রের থেকেও বেশি জনপ্রিয় সারা পৃথিবীতেই।
তবে শাইনিদের মতে, স্কুলপড়ুয়াদের জন্য ফ্যান্টাসির শেষ কথা হ্যারি পটার। দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ঋতম বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করে, জে কে রাউলিং এমন একটা ম্যাজিক দুনিয়া তৈরি করেছেন যে সেখানে গিয়ে পাকাপাকি ভাবে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে হয় পটারপ্রেমীদের।
সিটি সেন্টারের ক্রসওয়ার্ড-এ বই কিনতে আসা ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়া ঈশান চক্রবর্তী মন দিয়ে পটার-সিরিজের ‘ডেথলি হ্যালোস’ পড়ছিল স্টোরের চেয়ারে বসে। তার মা জানালেন, ঈশান বই পড়তে ভালবাসে। তবে জুল ভার্নের ‘জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ’, বা আলেকজান্ডার দুমার ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ নয়, ঈশান ভালবাসে হ্যারি পটার আর টিনটিন পড়তে। তবে এ বার সে বায়না শুরু করেছে অমিশ ত্রিপাঠীর ‘শিবা ট্রিলজি’ পড়ার জন্য। অমিশের ‘দ্য ইমর্টালস অব মেলুহা’, ‘দ্য সিক্রেট অব দা নাগাস’ এবং ‘দ্য ওথ অব দ্য বায়ুপুত্রস’হইহই ফেলে দিয়েছে অল্পবয়সিদের মধ্যে। হুড়মুড় করে বিক্রি হচ্ছে অমিশের বায়ুপুত্রস। কিন্তু কেন? “অমিশ পড়ার আগে আমার পুরাণের গল্প নিয়ে কোনও আগ্রহই ছিল না। উনি এতটা সমসাময়িক আর যুক্তিপূর্ণ ভাবে এ ধরনের গল্প বর্ণনা করেছেন, এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলি।” বলছিল মধ্য কলকাতার একটি স্কুলের ছাত্রী তৃণা দে।
তৃণার ব্যাপারটা আবার লক্ষ করার মতো। ও পুরনো ক্লাসিকস্ পড়ছে। ‘অলিভার ট্যুইস্ট’, ‘কাউন্ট অব মন্টিক্রিস্টো’ ‘টোয়েন্টি থাউজান্ড লিগ আন্ডার দ্য সি’র গল্প গড়গড়িয়ে বলে যেতে পারে। কিন্তু তার চেয়ে অমিশ ওকে বেশি টানে। |
এখন পড়ছি |
সমদর্শী দত্ত
লরেন্স গ্রোবেল-এর ‘কনভারসেশনস উইথ মার্লন ব্র্যান্ডো’ আমার জীবনী পড়তে খুব ভাল লাগে। অনেক অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হওয়া যায় সেই পরিস্থিতির সম্মুখীন না হয়েও। |
মিমি চক্রবর্তী
চার্লস ডিকেন্স-এর ‘দ্য ওল্ড কিউরিওসিটি শপ’ ক্লাসিক বলেই ই-বুকটা নিয়েছি। আস্তে আস্তে পড়ছি, কিন্তু বেশ ভাল লাগছে। |
গৌরব চক্রবর্তী
এরিক ভন দানিকেন-এর ‘চ্যারিয়টস অব দ্য গডস’ আমার বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে খুব আগ্রহ। তাই এই বইটা পড়ছি। |
|
তাক লাগানো বিপণনও আকর্ষণ করে অল্পবয়সি পাঠকদের। জনপ্রিয় ভারতীয় লেখকদের মধ্যে অনেকেই ম্যানেজমেন্ট, ব্যাঙ্কিং ইত্যাদি ক্ষেত্র থেকে উঠে আসছেন। তাঁরা বিপণনটাও ভাল বোঝেন। যেমন, অমিশ ত্রিপাঠীর প্রথম বইটি প্রকাশের সময় বইয়ের প্রথম অধ্যায় ছাপিয়ে তা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছিল বইয়ের দোকানে আসা লোকজনের মধ্যে। দ্বিতীয় বইটির সময় তো রীতিমতো বিভিন্ন মাল্টিপ্লেক্সে ভিডিয়ো ট্রেলার দেখানো হয়েছিল। স্পেশাল এফেক্টস্ দেওয়া সেই সব ভিডিয়ো দেখে মনে হচ্ছিল কোনও সিনেমার ট্রেলার। আর ‘ওথ অব বায়ুপুত্রস’-য়ের প্রকাশের দিন মুম্বইয়ের এক বুকস্টোরের সামনে লম্বা লাইন পড়ে দিয়েছিল অমিশ-ফ্যানদের। তাঁরা নিজেরাই বইয়ের চরিত্রদের মতো সেজে ‘হর হর মহাদেব’ বলে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন। উপযুক্ত মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি না নিলে অনেক ‘ভাল’ বইও আর পাঠক পর্যন্ত পৌঁছয় না বলে মন্তব্য করেছেন অমিশ নিজেই।
কেরিয়ার, গ্রুমিং, ব্যক্তিত্বের বিকাশ জাতীয় বইয়ের খুব চাহিদা বলে জানিয়েছেন রূপা পাবলিকেশন-এর অরুণ বসাক ও ‘স্টারমার্ক’- চেন এর ইয়ং অ্যাডাল্ট বিভাগের প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলেন, নন-ফিকশনে এই সব বইয়ের চাহিদা তুঙ্গে। যেমন রশ্মি বনশলের ‘স্টে হাংরি, স্টে ফুলিশ’ আর ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’য়ের বিক্রি প্রচুর। ম্যানেজমেন্ট গ্র্যাজুয়েটদের নিয়ে লেখা এই সব নন-ফিকশন থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন জেন ওয়াই-এর ছেলেমেয়েরা।
রূপা-র অরুণ বসাক জানালেন, অল্পবয়সি পাঠকদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে রবি সুব্রমনিয়ামের ব্যাঙ্ককেন্দ্রিক থ্রিলার ‘ইফ গড ওয়াজ আ ব্যাঙ্কার,’ ‘আই বট দ্য মঙ্কস্ ফেরারি’ ইত্যাদি। অন্য দিকে, রাধিকা মাধবনের ‘জব অ্যাট ফার্স্ট সাইট’-ও খুব জনপ্রিয়। আর ফেসবুক নিয়ে লেখা ‘দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল বিলিয়নেয়ার্স’ সব সময়ই হটকেক, জানিয়েছেন বই বিক্রেতারা।
এ সবের মধ্যে সিডনি শেলডন বা আগাথা ক্রিস্টির মতো কিছু লেখক কিন্তু বেশ কয়েকটি প্রজন্মকে ধরে রেখেছেন। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র শুভজিত্ সান্যাল মনে করেন, ঠিক যে কারণে জেমস বন্ড-এর উপন্যাস বা সিনেমা এই প্রজন্মও দেখে, সেই কারণেই শেলডন বা ক্রিস্টির মতো কিছু লেখক কখনও পুরনো হন না। আগাথা ক্রিস্টির গোয়েন্দা উপন্যাস এখনও বুদ্ধিদীপ্ত টিন-এজারদের কাছে সমান ভাবে আকর্ষণীয়। ক্রিস্টির জট খোলার পদ্ধতি এখনও টানে ছোট-বড় সকলকে। আর শেলডন এই সে দিন পর্যন্ত লিখেছেন। আকর্ষণীয় চরিত্র, গতি আর টানটান উত্তেজনার জন্য শেলডনের বই ধরলে শেষ না করে ওঠা মুশকিল।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। ওরা দুমা-জুল ভার্ন-স্টিভেনসন-হাগার্ড-হ্যারিয়েট স্টো’দের বাতিলই করে দিয়েছে। এখনও কিছু বুকস্টোরে হয়তো বা ‘আঙ্কল টমস কেবিন’, ‘কুয়ো ভাদিস’ কী ‘কিং সলোমনস্ মাইনস’ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। আর দু’দিন বাদে সেই চাওয়াটুকুও আর থাকবে না।
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
|
|
|
|
|