জাতীয় সন্ত্রাসবিরোধী কেন্দ্র (এনসিটিসি) গড়ার কেন্দ্রীয় প্রস্তাবটি আপাতত হিমঘরেই। এই প্রস্তাব রাজ্যগুলিকে দিয়া অনুমোদন করাইবার যাবতীয় প্রয়াস বানচাল হইয়াছে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দৃঢ় আপত্তি এ ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হইয়াছে। মোদী ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীদ্বয়ও ইতিপূর্বে এনসিটিসি-র ঘোর বিরোধিতা করিয়াছেন। দিল্লিতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের সদ্য-সমাপ্ত বৈঠকে তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও জয়রাম জয়ললিতা হাজিরাও দেন নাই, তবে প্রতিনিধি ও লিখিত স্মারকলিপি পাঠাইয়া নিজেদের প্রতিবাদ নথিভুক্ত করিতে ভুলেন নাই। বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ের অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীরাও এনসিটিসি-র সংশোধিত বয়ানটিকেও আপত্তিকর গণ্য করিয়াছেন। এনসিটিসি-র জনক পালনিয়াপ্পন চিদম্বরম (২০০৯ সালের ডিসেম্বরে যখন তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন) তাঁহার সাধের বন্দোবস্তটি বানচাল হওয়ায় যত্পরোনাস্তি ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধও। এ জন্য নরেন্দ্র মোদীকে তোপ দাগিতেও দ্বিধা করেন নাই। কিন্তু বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার সিন্দে সম্ভবত বুঝিয়া গিয়াছেন, রাজ্যগুলির অনুমোদন ছাড়া এই বন্দোবস্ত চালু হওয়া অসম্ভব।
এনসিটিসি সন্ত্রাস দমনের জন্য প্রস্তাবিত একটি নিরাপত্তা সংস্থা, যাহার সম্পর্কে কেন্দ্রের অভিলাষ ছিল ইহাই যে, সংস্থাটি পুরোপুরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন থাকিবে এবং রাজ্যে রাজ্যে তত্পর হইলেও কার্যত রাজ্য প্রশাসনের আওতার বাহিরে থাকিয়াই কাজ করিবে। সন্ত্রাসী সন্দেহে এই সংস্থার গোয়েন্দা ও নিরাপত্তাকর্মীরা যে কোনও স্থানে হানা দিতে পারিবেন, যাহাকে খুশি গ্রেফতার করিয়া জিজ্ঞাসাবাদও করিতে পারিবেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আইনশৃঙ্খলা যেখানে একান্ত ভাবেই রাজ্যের এক্তিয়ার কোনও রাজ্যই এই বন্দোবস্তে সায় দিতে পারে না। কেননা ইহা স্বীকৃত হইলে রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের জনপ্রতিনিধিত্বের বৈধতা লয় পায়, শাসনপ্রণালীর সার্বভৌমত্ব কেন্দ্রের কুক্ষিগত হইয়া পড়ে। স্বভাবতই প্রথমাবধি পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাত, তামিলনাড়ু সহ অ-কংগ্রেসি রাজ্য সরকারগুলি এই কেন্দ্রীয় প্রস্তাবের সঙ্গত ও তীব্র বিরোধিতা করিয়াছে। সেই বিরোধিতার সম্মুখে কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার আংশিক পিছুও হটে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তাকর্মীদের একতরফা যথেচ্ছাচার নিয়ন্ত্রণ করিয়া রাজ্যের পরামর্শদাতার ভূমিকা অংশত মানিয়া লওয়া হয়। তথাপি রাজ্যগুলির পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এই অনধিকারচর্চা শিরোধার্য করা সম্ভব হয় নাই। কারণটি সহজবোধ্য। যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবিন্যাসের চলতি বন্দোবস্তে রাজ্যের হাতে যেটুকু স্বাধিকার রহিয়াছে, এ ধরনের বন্দোবস্ত তাহাও কাড়িয়া লয়। এই প্রবণতাটি বিশেষ ভাবেই কংগ্রেস দলের মানসিকতার সহিত যুক্ত। স্বাধীনতার পর হইতেই দেখা গিয়াছে, এই দল মুখে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলিলেও ক্রমাগত রাজ্যগুলির এক্তিয়ার সঙ্কুচিত করিয়া কেন্দ্রকে শক্তিশালী করিতে চাহিয়াছে। যখন কেন্দ্রের পাশাপাশি সারা দেশেও কংগ্রেসেরই সরকার ছিল, তখন এ জন্য তাহাকে সমস্যায় পড়িতে হয় নাই, দলীয় স্বার্থের আধিপত্য এবং তদুপরি দলের প্রবল জাতীয় নেতাদের মহিমা যুক্তরাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্যের চেতনাকে আচ্ছন্ন করিয়াছিল, যাহার পরিণামে উদাহরণস্বরূপ মাসুল সমীকরণের মতো ভয়ানক অন্যায়ও বিধানচন্দ্র রায়ের মতো মুখ্যমন্ত্রী মানিয়া লইয়া কেবল পশ্চিমবঙ্গের নয়, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বড় ক্ষতি করিয়াছিলেন। কিন্তু ক্রমে রাজ্যে রাজ্যে অ-কংগ্রেসি দলগুলি ক্ষমতাসীন হইতে থাকায় এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তে প্রাদেশিক আত্মশাসনের এলাকাগুলি সুরক্ষিত রাখিতে উদ্যত হওয়ায় দ্বন্দ্ব ঘনাইয়া ওঠে। বর্তমানে এবং ভবিষ্যতেও কংগ্রেসের পক্ষে একক শক্তিতে কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল কার্যত অসম্ভব, বহু আঞ্চলিক ও প্রাদেশিক দলের (যাহারা আবার রাজ্যে রাজ্যে শাসক দল) জোট লইয়াই সরকার গড়িতে হইবে। তথাপি কংগ্রেস হাইকমান্ড দৃশ্যত এখনও এই রাজনৈতিক বাস্তবতাটি উপেক্ষা করার পক্ষপাতী। এখনও রাজ্যগুলিকে সমকক্ষের মর্যাদা দিয়া তাহাদের সহিত শলাপরামর্শ ও আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে কংগ্রেস সম্পূর্ণ একতরফা ভাবে উপর হইতে কোনও প্রশাসনিক বন্দোবস্ত চাপাইয়া দিতে পছন্দ করে। এনসিটিসি-র প্রস্তাবিত বন্দোবস্তে নরেন্দ্র মোদী সহ অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের আপত্তিতে চিদম্বরমের তীব্র উষ্মা সেই ভ্রান্ত মানসিকতারই প্রকাশ, যাহা যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থাকে এককেন্দ্রিক করিয়া তুলিতে চায়। |