চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
ই বাংলার এক জন সুপরিচিত ভাস্কর গোপালপ্রসাদ মণ্ডল। ১৯৭০-এর দশক থেকে তিনি নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর ভাস্কর্যের ভিতর তিনি শুধু রূপের জন্য রূপ সৃষ্টি করেন না। তাঁর কাজে সব সময়ই থাকে দার্শনিক অন্বেষণ, যা তাঁর সামগ্রিক জীবনবোধ থেকে সঞ্চারিত হয়। এক দিকে তিনি সমাজসচেতন শিল্পী। সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ব্যক্ত হয় তাঁর কাজে। অন্য দিকে জড় ও জীবনের মধ্যে সম্পর্ক, প্রকৃতি থেকে কেমন করে চৈতন্য বিকশিত হয়, এই ভাবনারও প্রতিফলন ঘটে। তাঁকে বলা যেতে পারে ১৯৭০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত ভাস্কর। ১৯৭৬-এ তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে ভাস্কর্যে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। ১৯৮১-তে বরোদা থেকে শিল্প-ইতিহাসে স্নাতকোত্তর শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতায় ১৯৭৮ সালে। সেই প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল ‘অর্গ্যানিক ক্রিস্টালিজম’। জৈব ও অজৈবের সম্পর্ক নিয়ে যে ভাবনা শুরু হয়েছিল সেই প্রথম পর্যায়ে, তারই নানা বিকাশ ঘটেছে তাঁর পরবর্তী বিবর্তনে। আমাদের ভাস্কর্যের আধুনিকতায় ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত রূপ নির্মাণের যে বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জিত হয়েছে, মণ্ডলের কাজের শুরু সেখান থেকে। ভাস্কর্যে ভারতীয় রূপবোধ ও পাশ্চাত্য আধুনিকতার অর্জনের সমন্বয়ের প্রয়াস ছিল সেই পর্যায়ে। সেই সূচনা থেকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাঁর রূপ-ভাবনা বিবর্তিত হয়েছে।
সম্প্রতি ইমামি চিজেল আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল তাঁর ৩৩টি ভাস্কর্য ও ৩৬টি ড্রয়িং নিয়ে প্রদর্শনী। সবই সাম্প্রতিক কালের রচনা। তাঁর ড্রয়িংগুলি খুবই স্বতঃস্ফূর্ত। নির্ভার, জঙ্গম, সারল্যময় বক্ররেখার সঞ্চলনে এঁকেছেন। একটি ছবিতে দু’টি নারীমুখ রয়েছে পাশাপাশি। মুখের গড়ন ডিম্বাকৃতি, প্রলম্বিত। খুব হালকা ধূসর ছায়াতপ ব্যবহার করেছেন মধ্যভাগে। পরিমিত রেখায় রূপায়িত হয়েছে চোখ, নাক ও মুখ। চোখ থেকে ঝরে পড়ছে বিন্দু বিন্দু জল। আনন্দ ও বিষাদের সমন্বিত অভিব্যক্তিতে বেরিয়ে এসেছে মানবীসত্তার অন্তর্লীনতা। ধ্রুপদী চেতনারই এক প্রকাশ বলা যায় একে। এই তন্ময়তার বিপরীত প্রান্তের আর একটি ড্রয়িং আমরা লক্ষ করতে পারি। সূক্ষ্ম রেখার সঞ্চলনে আঁকা হয়েছে বসে থাকা এক শীর্ণ নগ্ন পুরুষের অবয়ব। পেটে তার ক্ষুধার আগুন জ্বলছে। তার মুখে উচ্চারিত হচ্ছে ‘হা আল্লা’। আর একটি ড্রয়িংও বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঝরে পড়া পাতার আকৃতিতে গড়ে উঠেছে মানুষের মুখ। ড্রয়িং-এর সারল্যের মধ্যে প্রতিফলিত হয় শিল্পীর মন, যে মন নিয়ে তিনি ভাস্কর্যের নানা জটিল রূপে প্রবেশ করেন।
শিল্পী: গোপালপ্রসাদ মণ্ডল
সাদা মার্বেল পাথর কেটে করা নানা আঙ্গিকের অনেকগুলি গণেশের মুখ আছে প্রদর্শনীতে। ভারতীয় ভাস্কর্যের ধ্রুপদী রূপের আধুনিকীকরণ নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এগুলিতে। ব্রোঞ্জের আত্মপ্রতিকৃতিটিতেও তিনি স্বাভাবিকতা ও অন্তর্লীনতার সমন্বয় ঘটিয়েছেন। তবু মনে হয় আর একটু ভাঙলে তাঁর ব্যক্তিত্বের আলোছায়া আরও পরিস্ফুট হত। যেমন আমরা দেখি ‘লোডশেডিং’ শিরোনামের ব্রোঞ্জের রচনাটিতে। পাখা হাতে বসে আছে এক জন মানুষ। স্বাভাবিকতার ভিতর আদিমতা মিশেছে প্রচ্ছন্ন ভাবে। তাতেই অবয়বটি অর্জন করেছে অন্তর্নিহিত শক্তি।
স্বাভাবিকতায় তাঁর যেমন দক্ষতা, তেমনই স্বাভাবিকতাকে অভিব্যক্তিবাদী আঙ্গিকে ভেঙে তিনি প্রবেশ করেন চেতনার আলো-আঁধারি পরিসরে। কাঠের একটি বড় কাজ রয়েছে ‘পুরুষ ও প্রকৃতি’ শিরোনামে। একটিই বড় কাঠ কেটে বের করে এনেছেন দু’টি অবয়ব। ষাটের দশকের উত্তরাধিকারের মধ্যেই এখানে আত্মস্থ করতে চেষ্টা করেছেন পাশ্চাত্য আধুনিকতাবাদী ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য। ‘ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট’ মার্বেলের কাজ রয়েছে, তাতে তিনি অভিব্যক্তিকে বিমূর্ততার দিকে নিয়ে গেছেন।
যান্ত্রিক ও প্রাকৃতিক রূপের মধ্যে সমন্বয় ও সংঘাত নিয়ে কাজ রয়েছে বেশ কয়েকটি। ‘সিমবায়োসিস’ ও ‘লাস্ট জার্নি’ রচনা এর দৃষ্টান্ত। ‘ওয়ে টু হেভেন’ ব্রোঞ্জ ও অ্যালুমিনিয়মের রচনাটিতে তিনি জীবন থেকে মৃত্যুর দিকে অভিযাত্রার আবহ তৈরি করেছেন। তাঁর রূপভাবনা ও দর্শনচেতনার এক সমন্বয় ঘটেছে এখানে। তা সত্ত্বেও ১৯৮৮তে তৈরি ‘নিকারাগুয়া’ ব্রোঞ্জটিতে বিশ্বমানবতার অবক্ষয়ের যে প্রতীক, তাতেই তাঁর শিল্পীসত্তার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ আমরা দেখতে পাই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.