‘বেসিক ইনস্টিংক্ট’ আর ‘ফেটাল অ্যাট্রাকশন’। ক্যানসারের সঙ্গে এ দুয়ের যোগাযোগ আরও ঘনিষ্ঠ হল ওই দু’টি ছবির নায়ক, মাইকেল ডগলাসেরই সৌজন্যে।
একাধিক যৌনসঙ্গী থাকলে যে জরায়ুমুখ ক্যানসারের আশঙ্কা বাড়ে, সেটা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। এ বার ‘ওরাল সেক্স’-এর সঙ্গে মুখের ক্যানসারের যোগসূত্র নিয়ে পৃথিবী জুড়ে হইচই ফেলে দিলেন হলিউডের অভিনেতা ডগলাস। যদিও চিকিৎসক মহল মনে করছে, ডগলাসের ঘটনায় হয়তো বিষয়টা নিয়ে হইচই হচ্ছে। কিন্তু এটা কোনও নতুন তথ্য নয়।
তিন বছর আগে ক্যানসার ধরা পড়ে ডগলাসের। রোগটা তখনই একেবারে চতুর্থ পর্যায়ে। শুরু হয় কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির প্রক্রিয়া। যৌবনে মাদক সেবন করতেন। পরবর্তী কালে মদ্যপান এবং ধূমপান, দু’রকম আসক্তিই ভাল রকম ছিল ডগলাসের। সুতরাং গলার ক্যানসারের কারণ খুঁজতে কাউকেই খুব বেশি কিছু ভাবতে হয়নি। শুধু একটা গুঞ্জন ছিল, ডগলাসের ক্যানসারটা সত্যিই গলায়, নাকি মুখের ভিতরের অংশে (ওরোফ্যারিঞ্জিয়াল)?
তিন বছর পরে ডগলাসের দাবি, তিনি এখন সুস্থ। দিন দুয়েক আগে ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন, মদ্যপান-ধূমপান তো আছেই। কিন্তু তাঁর নিজের মনে হয়, তাঁর ক্যানসারের পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ ‘ওরাল সেক্স’-এর অভ্যাস। একই সঙ্গে তিনি এও দাবি করেন, রোগ যদি হয়েই যায়, তখন আবার ‘ওরাল সেক্স’ই রোগটা সারাতেও সাহায্য করে।
রোগ সারানোর ব্যাপারটা নিয়ে অবশ্য ডগলাসের কথার তেমন কোনও যৌক্তিকতা চিকিৎসকরা খুঁজে পাচ্ছেন না। কিন্তু হ্যাঁ, ওরাল সেক্সের সঙ্গে মুখের ক্যানসার বা ওরোফ্যারিঞ্জিয়াল ক্যানসারের নিবিড় যোগ রয়েছে বলেই জানাচ্ছেন তাঁরাও। মদ খাওয়ার অভ্যাস নেই, ধূমপানও করেন না, অথচ ওরোফ্যারিঞ্জিয়াল ক্যানসার হয়েছে, এমন ঘটনা বিরল নয়। চিকিৎসকদের বক্তব্য, এমন অল্পবয়সী রোগীদের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, তাঁদের একটা বড় অংশেরই ‘ওরাল সেক্স’-এর অভ্যাস রয়েছে।
কলকাতার চিকিৎসক মহলের একটা বড় অংশও মনে করছেন, বিষয়টি প্রাসঙ্গিক। তাঁদের বক্তব্য, এত দিন জরায়ুমুখ ক্যানসারের ক্ষেত্রে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের (এইচপিভি) ভূমিকা জানা ছিল। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পায়ু ক্যানসারের ক্ষেত্রেও মিলত এইচপিভি। এ বার মুখের ক্যানসারেও তার ভূমিকার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এই ভাইরাসের বাহক প্রধানত পুরুষ। পুরুষের মাধ্যমেই এইচপিভি প্রবেশ করে মেয়েদের শরীরে। কিন্তু ‘ওরাল সেক্সে’র মাধ্যমে এইচপিভি-১৬ প্রবেশ করতে পারে নারী বা পুরুষ যে কারও মধ্যে। তবে চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন এইচপিভি সরাসরি ক্যানসার ডেকে আনে না। এটি সংক্রামিত কোষগুলিকে পরিবর্তিত করে, তার জেরে কারও কারও ক্যানসার হয়।
আমেরিকার একটি গবেষণায় জানা গিয়েছে, ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মুখের ক্যানসারের ঘটনার পিছনেই দায়ী এইচপিভি। লন্ডনের একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, ওখানে মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত ১৩১৬ জন রোগীর মধ্যে ৫৭ শতাংশই এইচপিভি-১৬ পজিটিভ। |
উপসর্গ |
• তিন সপ্তাহেরও বেশি থেকে যাওয়া ঘা
• মুখের ভিতরে সাদা বা লাল দাগ
• গলায় কিছু আটকে থাকার অনুভূতি
• জিভে, চোয়ালে, গলায় ব্যথা
• গলা ভেঙে যাওয়া
• কোনও কারণ ছাড়াই দাঁত নড়া |
|
কলকাতার ক্যানসার শল্য-চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “বিদেশে তো একাধিক গবেষণায় বিষয়টা ভাল ভাবে প্রমাণিত। এখানেও আমরা বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এমন অজস্র নজির পাচ্ছি। গোড়ায় ধরা পড়লে এর সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। তাই সচেতনতা বাড়ানোটা খুব জরুরি।” ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “ইদানীং বহু অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে গলায়, জিভে ক্যানসার নিয়ে আসছেন। এঁদের অনেকেরই ওরাল সেক্সের অভ্যাস রয়েছে। সমকামীদের মধ্যেও এই সমস্যাটা বাড়ছে।” চিকিৎসকরা তাই বিশেষ করে মেয়েদের সাবধান হতে পরামর্শ দিচ্ছেন। অসুরক্ষিত যৌন সংসর্গ ও ‘ওরাল সেক্স’ থেকে বিরত থাকতে বলছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত ওরাল সেক্সের ফলে এমনিতেও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে শুরু করে। যে সব ভাইরাস আধা-ঘুমন্ত হয়ে শরীরে ছিল, সেগুলো রাতারাতি জেগে উঠতে শুরু করে। কখনও কখনও তা থেকেই ক্যানসার হয়। তার উপরে এইচপিভি-র ভূমিকা তো থাকছেই। সারা পৃথিবী জুড়ে যখন এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তখন মাইকেল ডগলাস অবশ্য তাঁর বক্তব্য থেকে কিছুটা পিছু হটেছেন। তাঁর মুখপাত্রের মাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে ক্যাথরিন জিটা-জোনসের স্বামী এখন বলছেন, তাঁর কথার ভুল ব্যাখ্যা হচ্ছে। ডগলাসের দাবি, উদ্দাম ওরাল সেক্স থেকেই তাঁর ক্যানসার হয়েছে, এ কথা তিনি বলতে চাননি। সার্বিক ভাবে গলা ও মুখের ক্যানসারের পিছনে ওরাল সেক্স-এর ভূমিকার কথাই বলছিলেন তিনি।
ডগলাসের বক্তব্য যাই হোক না কেন, ক’দিন আগেই অ্যাঞ্জেলিনা জোলির ম্যাসটেক্টমির সূত্রে স্তন ক্যানসার যেমন আলোচনার শীর্ষে এসেছিল, ডগলাসের সাক্ষাৎকারটিও যৌনতা ও ক্যানসারের সম্পর্ক নিয়ে সতর্কতা বাড়াচ্ছে। স্ত্রীরোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “মেয়েদের জরায়ুমুখ ক্যানসারের পিছনে এই ভাইরাসের ভূমিকা আমরা জানতাম। মুখের ক্যানসারে এইচপিভির ভূমিকা আমরা এখনও ততটা জানি না। যদি হয়, তা হলে বিষয়টি মারাত্মক।”
প্রশ্ন উঠেছে, জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে যে প্রতিষেধক এসেছে বাজারে, সেই একই প্রতিষেধক মুখের ক্যানসার ঠেকাতেও প্রযোজ্য হবে কি? কারণ দুয়ের মূলেই রয়েছে এইচপিভি ভাইরাস। চিকিৎসক মহলের একটা বড় অংশ জানিয়েছেন, মুখের ক্যানসারের ক্ষেত্রে এই প্রতিষেধকের কার্যকারিতা এখনও প্রমাণিত নয়। সুবীরবাবু বলেন, “ভাইরাস শরীরে ঢোকার ২০ বছর পরেও রোগটা হতে পারে। নিয়মিত তো কেউ ভাইরাল স্টাডি করান না। আগাম আশঙ্কায় প্রতিষেধক ইঞ্জেকশন নিয়ে আরও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ডেকে আনার কোনও অর্থ হয় না।” |