রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দাবি মেনে পঞ্চায়েত ভোটে সশস্ত্র বাহিনীর ব্যবস্থা করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিল হাইকোর্ট। রাজ্যও জানিয়ে দিল, গত ২২ মে প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে কমিশন যে পরিমাণ বাহিনী দাবি করেছে, তা দিতে তাদের আপত্তি নেই। ফলে আপাতদৃষ্টিতে সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে সরকার-কমিশন দ্বন্দ্বে ইতি পড়ল বলে মনে হলেও শেষ পর্যন্ত ঠিক কত বাহিনী পাওয়া যাবে, সেই সংশয় কিন্তু কাটল না। কারণ, এমন একটা সময়ে বাহিনী নিয়ে রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন সহমতে পৌঁছল, যখন বাহিনী জোগাড় করা কার্যত অসম্ভব বলেই অনেকে মনে করছেন।
২২ মে রাজ্যকে দেওয়া কমিশনের তালিকা অনুযায়ী পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য দরকার ১ লক্ষ ৪৬ হাজার সশস্ত্র বাহিনী। প্রথম দফার ভোট (এই পর্যায়েই সব চেয়ে বেশি ৯টি জেলায় ভোট) করতে দরকার ১ লক্ষ ১৬ হাজার ১৩৭ সশস্ত্র বাহিনী। সেই সময় অন্যত্র ভোট প্রক্রিয়া চালাতে আরও ৩০ হাজার সশস্ত্র বাহিনী দরকার হবে। তার পরের দু’টি পর্যায়ে অবশ্য বাহিনীর চাহিদা কমে যাবে। কিন্তু রাজ্য সরকারের কাছে এই মুহূর্তে মেরেকেটে ৫০ হাজার বাহিনী (জঙ্গলমহলে মোতায়েন করা ৪ হাজার কেন্দ্রীয় বাহিনী ধরে) রয়েছে।
রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায় অবশ্য প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ এবং নির্বাচন কমিশনকে বাহিনী দেওয়ার প্রশ্নে আশ্বস্ত করেছেন। হাইকোর্টের নির্দেশ রাজ্য সরকার অক্ষরে অক্ষরে মানবে বলেও আদালতকে কথা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু বাকি বাহিনী কোথা থেকে আসবে তা এ দিন রাত পর্যন্ত স্পষ্ট করে জানাতে পারেননি স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তারা। ফলে এজি-র আশ্বাসে তাঁরা পুরোপুরি ভরসা পাচ্ছেন না জানিয়ে কমিশন সূত্রে ফের বলা হয়েছে, চাহিদামতো বাহিনী না-পেলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়।
|
রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা এ দিন বলেন, প্রথম দফার ভোট নিয়েই তাঁরা চিন্তিত। বাকি দুই দফার ভোট রাজ্যে যা বাহিনী রয়েছে তার সাহায্যেই হয়ে যাবে। প্রথম দফার ভোট ২ জুলাই। আজ, বুধবার তার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কাজ শেষ হচ্ছে। মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর্বে ৩২১ কোম্পানি সশস্ত্র বাহিনী চেয়েছিল কমিশন। কিন্তু রাজ্য মঙ্গলবার পর্যন্ত মাত্র ৩৫ কোম্পানি দিতে পেরেছে। তিনটি
রাজ্য থেকে ১৩০ কোম্পানি এবং কেন্দ্রের কাছ থেকে ৩০০ কোম্পানি সশস্ত্র বাহিনী চেয়েছে রাজ্য। কিন্তু কোনও জায়গা থেকেই ইতিবাচক সাড়া মেলেনি।
পর্যাপ্ত বাহিনী পাওয়া না-গেলে শেষ পর্যন্ত কি পঞ্চায়েত ভোট পিছিয়ে যাবে? রাজ্য প্রশাসনের এক পদস্থ কর্তা বলেন, কমিশন যদি নির্বাচনকে আরও কয়েকটি দফায় ভাগ করে দেয়, তা হলে বাড়তি বাহিনী ছাড়াই ভোট হওয়া সম্ভব। এ ব্যাপারে আইনগত দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কমিশনের সূত্র বলছে, ২০০৩ সালের রাজ্য পঞ্চায়েত নির্বাচন আইনের ১৩৭ নম্বর ধারা প্রয়োগ করে তারা নতুন করে নির্ঘণ্ট তৈরি করতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ফের ডিভিশন বেঞ্চে গিয়ে অনুমতি নিতে হবে কমিশনকে। ডিভিশন বেঞ্চ এ দিন বলেছে, তাদের নির্দেশ কার্যকর করতে গিয়ে কোনও পক্ষ কোনও সমস্যায় পড়লে তারা যে কোনও সময়ে হাইকোর্টে এসে তা জানাতে পারবে।
নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ার নিয়ে রায় না দিলেও প্রধান বিচারপতি এ দিন মামলার শুরুতেই এ ব্যাপারে তাঁর মতামত জানিয়ে দেন। তিনি বলেন নির্বাচন পরিচালনার জন্য সব ব্যবস্থা নেওয়ার এক্তিয়ার কমিশনেরই। সংবিধান তাকে সেই অধিকার দিয়েছে। ডিভিশন বেঞ্চ আরও জানিয়ে দেয় ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোটারদের আস্থা অর্জন, এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা, প্রার্থীদের নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে কমিশন যে সূত্র অনুসরণ করেছিল, এ বারও তা করা যাবে।
কমিশনের আইনজীবী সমরাদিত্য পাল এ দিনও প্রধান বিচারপতিকে জানান, মনোয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় থেকে প্রচার পর্ব চলাকালীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা জরুরি। ব্লকে ব্লকে পুলিশের টহল, নজরদারি বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রার্থীদের মনে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতেই পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই ধরনের পদক্ষেপ করা প্রয়োজন বলে তিনি দাবি করেন। তাঁর মতে, কোথায়, কী ভাবে, কত সংখ্যক, পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা দরকার, তা রাজ্য সরকার ভালই জানে।
অন্য দিকে বিমলবাবু বলেন, রাজ্য সরকারও চায় প্রার্থীরা নির্ভয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিন। সরকার চুপ করে বসে নেই। আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কোনও অভিযোগ এলে সরকার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। কমিশন এমন একটি ঘটনাও দেখাতে পারবে না যে রাজ্য অভিযোগ পেয়েও ব্যবস্থা নেয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে স্বাভাবিক তার প্রমাণ দিতে অ্যাডভোকেট জেনারেল বলেন, “প্রথম দফার ভোটের মনোয়নপত্র জমা নেওয়া চলছে। গত কয়েক দিনের হিসেবে বিরোধী দল, শাসক দলের থেকে অনেক বেশি মনোনয়নপত্র জমা দিতে পেরেছে। এটা সম্ভব হল কী করে?” রাজ্য সরকারের কাছে চেয়েও ভোট করানোর জন্য টাকা পাওয়া যাচ্ছে না বলে সোমবার আদালতে নালিশ করেছিল কমিশন। রাজ্যের তরফে এ দিন জানানো হয়, সোমবারই কমিশনের চাহিদামতো ৪৮ কোটি ৮১ হাজার ৬৪ হাজার টাকার চেক তৈরি হয়ে গিয়েছে। কমিশন শীঘ্রই তা পেয়ে যাবে।
|