ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়লেও স্কুল স্তরে পঠনপাঠনের মান আশানুরূপ ভাবে উন্নত হচ্ছে কি না, চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল তা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
এ বার মোট পরীক্ষার্থীর মাত্র ১৪.৯৬ শতাংশ ছাত্রছাত্রী ৬০ শতাংশ বা তার বেশি নম্বর পেয়েছেন। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের তথ্য অনুযায়ী ২০১১ থেকে এই হার ক্রমশ কমছে। ২০১১-য় উচ্চ মাধ্যমিকে ১৮ শতাংশ পরীক্ষার্থী ৬০ শতাংশ বা তার বেশি নম্বর পেয়েছিলেন। ২০১২-য় সেটা কমে হয় ১৬.৪৭ শতাংশ। এ বার তা আরও কমে গেল।
এই অধোগতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত অভিজ্ঞেরা। তবে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু আশ্বাস দিয়েছেন, এই পরিস্থিতি বদলাবে। তাঁর কথায়, “পাঠ্যক্রম পাল্টে, পরিকাঠামো বাড়িয়ে, পরীক্ষাগারের জন্য প্রচুর অনুদান দিয়ে সরকার শিক্ষার মান বাড়াতে সচেষ্ট হয়েছে। আশা করি, এই উদ্যোগের ফল আগামী দিনে পাওয়া যাবে।” উচ্চ মাধ্যমিকের সফল পরীক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানান শিক্ষামন্ত্রী।
এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিকের ফল সোমবার প্রকাশিত হয়েছে। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল সাত লক্ষ ৪৩ হাজার ৭০৭। পাশের হার ৭৭.৩৫ শতাংশ। ছাত্রদের পাশের হার ৭৯.৪৪ শতাংশ, ছাত্রীদের ৭৫.০৮ শতাংশ। পাশ করেছেন পাঁচ লক্ষ ৬৮ হাজার ১৫ জন। তাঁদের মধ্যে এক লক্ষ ১১ হাজার ২৬০ জন ৬০ শতাংশ বা তার বেশি নম্বর পেয়েছেন। শতাংশের বিচারে ১৪.৯৬। এ বছর ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ নম্বর পাওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও গত বারের থেকে কমে গিয়েছে। গত বছর ৪৭২ জন ৯০ থেকে ১০০ শতাংশের মধ্যে নম্বর পান। এ বার তা পেয়েছেন ৪৩৩ জন।
|
সাফল্যের হাসি। সোমবার কলকাতার একটি স্কুলে। —নিজস্ব চিত্র |
উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এ দিন মেধা-তালিকাও প্রকাশ করেছে সংসদ। প্রথম ১০টি স্থানে জায়গা করে নিয়েছেন ৩৭ জন পরীক্ষার্থী। তাতে কলকাতার সাত জন আর বিভিন্ন জেলার ৩০ জন আছেন। অর্থাৎ এই ব্যাপারে কলকাতা-সহ জেলাগুলি অগ্রগতির স্বাক্ষর রেখেছে। কিন্তু উদ্বেগ বাড়িয়েছে ৬০ শতাংশ বা তার বেশি নম্বর পাওয়া পড়ুয়াদের হার কমতে থাকার বিষয়টি।
এখন গ্রেডের আমল। ডিভিশন বা বিভাগের বদলে গ্রেডেরই উল্লেখ করা হয়। তবে ন্যূনতম ৬০ শতাংশ নম্বর পেলে সেটাকে প্রথম বিভাগের তকমা দেওয়াটা দীর্ঘ কালের রেওয়াজ। সেই অর্থে উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগ পাওয়ার হারই কমে চলেছে। কেন?
সংসদ-সভাপতি মুক্তিনাথ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। তাঁর বক্তব্য, যাঁরা মাধ্যমিক পাশ করে আসেন, তাঁদের মানের উপরে উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল অনেকটা নির্ভরশীল। সেই দিকটিও বিবেচনা করা দরকার। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়ও মনে করেন, এই বিষয়ে ভাবনাচিন্তার অবকাশ রয়েছে। তিনি জানান, পর্ষদের নিজস্ব বিশেষজ্ঞ কমিটি, শিক্ষা সেকশন, স্কুলশিক্ষা দফতর এবং অন্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
এর একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সংসদের এক প্রাক্তন সভাপতি। তাঁর বক্তব্য, এ বছর প্রশ্নের ধরন কিছুটা অদলবদল হয়েছে। ভাল নম্বর পেতে হলে পাঠ্যবই খুব ভাল করে পড়া দরকার ছিল। ৬০ শতাংশ বা তার বেশি নম্বর পাওয়া পরীক্ষার্থীর হার যে ক্রমশ কমে যাচ্ছে, পাঠ্যবই ভাল করে না-পড়ার অভ্যাস তার অন্যতম কারণ হতে পারে।
রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ দে-র অনুযোগের আঙুল আবার পরীক্ষকদের দিকে। তাঁর মতে, “নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এখনও কিছুটা জড়তা রয়ে গিয়েছে। তাই যোগ্যতা থাকলেও অনেক পরীক্ষার্থীই ৬০ শতাংশ বা তার বেশি নম্বর থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
শিক্ষা-গবেষক মর্মর মুখোপাধ্যায় অবশ্য এর বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মধ্যে আছে পরীক্ষার্থীদের সামাজিক অবস্থানের বিষয়টিও। তাঁর কথায়, “দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছরই পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। এদের বেশির ভাগই আসছে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ থেকে। এদের পরিবারে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় সাহায্য করার কেউ নেই। পরীক্ষার ফলেও এর প্রভাব পড়ে।” ক্লাসে পড়ানোর পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন এনে তাকে পরীক্ষা প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা যায় কি না, সেটা দেখা দরকার বলে মনে করেন মর্মরবাবু। যদিও প্রায় ১৫ শতাংশ ছেলেমেয়ের ৬০ শতাংশ বা তার বেশি নম্বর পাওয়া খুব একটা খারাপ ফল বলে মনে করেন না ওই প্রবীণ গবেষক। তিনি বলেন, “দেশের অন্য অনেক রাজ্যের থেকে এই হার ভাল। তবে বছর বছর তা কমতে থাকলে সেটা চিন্তার বিষয়।”
অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পৃথ্বীশ বসু এবং শিক্ষিকা মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যক্রম এবং মূল্যায়ন পদ্ধতির মানেই ফারাক আছে। মাধ্যমিকে যত সহজে ভাল ফল করা যায়, উচ্চ মাধ্যমিকে তত সহজে করা যায় না। এটা উচ্চ মাধ্যমিকে ৬০ শতাংশ বা তার বেশি নম্বর পাওয়া পড়ুয়ার সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। পৃথ্বীশবাবু মনে করেন, ক্লাসে কী ভাবে পড়ালে ভাল ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়ানো যাবে, তা নিয়ে বাস্তবসম্মত কর্মশালার প্রয়োজন আছে। মনীষাদেবীর কথায়, “পড়াশোনার সার্বিক চিত্র ভাল নয়। স্কুলগুলিতে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পরিকাঠামো খারাপ।”
উচ্চ মাধ্যমিকে ৮৫ শতাংশেরও বেশি পরীক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর ৬০ শতাংশের কম। তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংসদ-সভাপতি উদ্বিগ্ন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “স্নাতক স্তরে বৃত্তিশিক্ষা চালু করার ব্যাপারে আলোচনা চলছে।” এ বছর থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে নতুন পাঠ্যক্রম চালু হয়েছে। ভবিষ্যতে পরীক্ষার ফলাফলে এর একটা প্রভাব পড়বে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সংসদ-সভাপতি। |