নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনকে ঘিরে বিতর্কের রেশ কাটার আগেই নতুন ঝড় আছড়ে পড়ল ভারতীয় ক্রিকেটে।
এ বার ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। যিনি একই সঙ্গে শ্রীনিবাসনের দল চেন্নাই সুপার কিংস-এরও অধিনায়ক। এবং শ্রীনিবাসনের ইন্ডিয়া সিমেন্টস-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট।
অনেকেই রসিকতা করে বলছেন, শ্রীনি-র পরে ধোনি!
ঘটনার শুরু সোমবার সকালে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় যে, ‘রীতি স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি সংস্থায় পনেরো শতাংশ মালিকানা আছে ভারত অধিনায়কের। যে সংস্থা চালান ধোনিরই এজেন্ট এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু অরুণ পাণ্ডে। আরও জানা যায়, সুরেশ রায়না, রবীন্দ্র জাডেজা, প্রজ্ঞান ওঝা এবং আর পি সিংহ এই চার ক্রিকেটারের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বেও রয়েছে ওই সংস্থাটি। তাৎপর্যপূর্ণ হল, এই চার ক্রিকেটারই হয় এখন খেলছেন, না হলে আগে চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে খেলেছেন! এবং ক্রিকেট মহলে এঁরা প্রত্যেকে ধোনির ঘনিষ্ঠ হিসেবেই চিহ্নিত। এমনকী নিজের প্রভাব কাটিয়ে এঁদের কোনও না কোনও সময় জাতীয় দলে ঢোকানোর অভিযোগও উঠেছে বিক্ষিপ্ত ভাবে। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই শুরু হয় তীব্র বিতর্ক। প্রশ্ন ওঠে, কী ভাবে এটা হল? যে সংস্থায় ধোনির মালিকানা রয়েছে, অর্থাৎ সাদা চোখে যাকে ভারত অধিনায়কের সংস্থা বলা যেতেও পারে, সেই সংস্থাই কিনা রায়না-জাডেজা-ওঝাদের ম্যানেজমেন্টের দিকটা দেখছে! অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যমও প্রশ্ন তোলে, এটা কী ভাবে সম্ভব? বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এটা পরিষ্কার ‘কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট’! ক্রিকেট স্বার্থ ও ব্যবসায়িক স্বার্থের সংঘাত! তাঁদের ব্যাখ্যা, ধোনি যে টিমের অধিনায়ক, সেই টিমের ক্রিকেটারদেরই নিজের কোম্পানিতে ঢুকিয়েছে! আর সেই ক্রিকেটাররা কারা? না, যাঁদের নাম বরাবরই ধোনির ‘গুড বুক’-এ! পাশাপাশি এই প্রশ্নও ওঠে, ধোনি ভারতীয় বোর্ডের চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার। তিনি কী ভাবে অন্য এক সংস্থার শেয়ারহোল্ডার হতে পারেন? |
সোমবার দিনভর বিষয়টি নিয়ে ক্রিকেটমহল তোলপাড় হলেও একটি শব্দও পাওয়া যায়নি ভারত অধিনায়কের মুখ থেকে। দুপুরের দিকে আর পি সিংহ টুইট করে জানিয়ে দেন, তাঁর সঙ্গে রীতি স্পোর্টসের কোনও যোগাযোগ নেই। আর সন্ধ্যায়, যে সংস্থায় ধোনির শেয়ার ঘিরে বিতর্ক, সেই ‘রীতি স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট’-এর অন্যতম অংশীদার অরুণ পাণ্ডে এক বিবৃতিতে বলেন, “এই মুহূর্তে ধোনির রীতি স্পোর্টসে কোনও মালিকানা নেই। এটাও পরিষ্কার করে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, ২২ মার্চ ২০১৩-য় একটা বাণিজ্যিক জট কাটাতে কিছু শেয়ার ধোনির নামে করা হয়। কিন্তু সেটা মাসখানেকের জন্য। বাণিজ্যিক জট কেটে যাওয়ার পরে ২৬ এপ্রিল ওই শেয়ারগুলো কোম্পানির প্রোমোটারকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।”
কিন্তু এই বিবৃতিকে সে ভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন না প্রায় কেউই। তা ছাড়া, অরুণ পাণ্ডের বিবৃতি নিয়ে অন্য প্রশ্নও উঠছে। কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রকে দেওয়া নথি অনুযায়ী ‘রীতি এমএসডি আলামোদে প্রাঃ লিঃ’ নামে যে সংস্থায় রীতি স্পোর্টস-এর ৫ শতাংশ, অরুণ পাণ্ডের ৩০ শতাংশ শেয়ারের সঙ্গে ধোনি এবং তাঁর স্ত্রী সাক্ষীর ৬৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে, সেই সংস্থাটি নিয়ে কেন কোনও বিবৃতি এল না? কেন বিবৃতি শোনা গেল না ‘স্পোর্টসফিট ওয়র্ল্ড ওভারসিজ সংস্থাটি’ নিয়ে, যাতে ‘রীতি এমএসডি আলামোদে প্রাঃ লিঃ’-এর ৭৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে? সেই রীতি এমএসডি আলামোদে, যাতে ধোনি ও তাঁর স্ত্রীর নামে সিংহভাগ শেয়ার রয়েছে! আরও আছে। অরুণ পাণ্ডে বিবৃতি দিয়ে যা-ই বলুন, সোমবার রাতেও রীতি স্পোর্টস-এর ওয়েবসাইট জুড়ে শুধুই মহেন্দ্র সিংহ ধোনি! মাহি রেসিং, এমএসডি চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশন...! অবশ্য পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে বিবৃতি দিয়েও আগুন নিভত বলে মনে হয় না! প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং বর্তমান সাংসদ কীর্তি আজাদের কটাক্ষ, “জানতে পারলাম যে রীতি স্পোর্টসে ধোনির মালিকানা রয়েছে। যে সংস্থা আবার কিছু ভারতীয় ক্রিকেটারেরও দায়িত্বে আছে! শ্রীনিবাসন যে সংস্থার মালিক, সেই ইন্ডিয়া সিমেন্টসের ভাইস প্রেসিডেন্টও আবার ধোনি। দেখা যাক, এটাকে কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট বলা হয় কি না!” আর এক প্রাক্তন ক্রিকেটার মনিন্দর সিংহ তো সাফ বলেই দিচ্ছেন, “ধোনির সংস্থা যে প্লেয়ারদের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আছে, তারা তো অন্যায় সুবিধে পাবেই!” আর এক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের মন্তব্য, “ক্ষমতা অলিন্দে ধোনির অবাধ গতিবিধি। যে ধোনি বিসিসিআই প্রেসিডেন্টের চেন্নাই সুপার কিংস-এর অন্যতম মাথা, বিসিসিআই প্রেসিডেন্টের কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট, তার বিরোধিতা কে করবে?”
অন্তর্বর্তী বোর্ড প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সিএবি-তে তাঁর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে বসে ধোনি নিয়ে বাউন্সার ছুটে গিয়েছে জগমোহন ডালমিয়ার দিকেও। ডালমিয়া বলেছেন, “একটু ধৈর্য ধরুন। এই ব্যাপারটা নিয়েও আমরা আলোচনায় বসব। কিন্তু এখনই নয়।” |
‘ক্যাপ্টেন কুল’ ধোনির বিরুদ্ধে ‘কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট’-এর অভিযোগ কিন্তু এটাই প্রথম নয়। চেন্নাই সুপার কিংস, ইন্ডিয়া সিমেন্টস-এর সঙ্গে তাঁর যোগ নিয়ে এত দিন প্রশ্ন উঠলেও তা সে ভাবে গুরুত্বই পেত না বোর্ডের অন্দরমহলে! খুঁচিয়ে বিপদে পড়তে চাননি কেউই। তাই সোমবারের মতো এমন সরব প্রতিবাদ কখনওই ঘটেনি। শুধু ডালমিয়াকে নয়, বোর্ড কর্তাদের যাঁকেই সামনে পাওয়া গিয়েছে, তাঁকেই ধোনি নিয়ে প্রশ্ন করেছে জাতীয় মিডিয়া। ভারতীয় বোর্ডের যুগ্ম-সচিব অনুরাগ ঠাকুর যেমন। তিনি বলেছেন, “এই প্রথম ব্যাপারটা শুনছি। ব্যাপারটা সত্যিই চিন্তার কারণ হলে নিশ্চয়ই এটা নিয়ে বসা হবে।” উৎসাহী মিডিয়ার কেউ কেউ সরাসরি ধোনিকে ই-মেলও করেন। যদিও কোনও উত্তরই পাননি।
স্পট-ফিক্সিং কেলেঙ্কারি নিয়ে আজ পর্যন্ত সে ভাবে কিছু বলতে শোনা যায়নি ভারত অধিনায়ককে। সচিন বিবৃতি দিয়েছেন। রাহুল দ্রাবিড় আইপিএল চলাকালীনই সরাসরি স্পট-ফিক্সিং নিয়ে একের পর এক প্রশ্নের মোকাবিলা করেছেন। সেখানে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রাক্কালে লন্ডনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই প্রসঙ্গে ধোনির শুকনো উত্তর ছিল, “সময় এলেই মুখ খুলব।”
এ বারে কী বলবেন ‘ক্যাপ্টেন কুল’?
তাকিয়ে দেশের ক্রিকেট পাগল জনতা।
|