নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন ক্রমাগত ক্ষুব্ধ স্বরে প্রশ্ন করিতেছেন, তিনি কোনও অন্যায় করেন নাই, তাঁহার কোনও অন্যায় প্রমাণিত হয় নাই, তাঁহার জামাতার অন্যায়ের জন্য তাঁহাকে কেন পদত্যাগ করিতে হইবে? তিনি একই সঙ্গে প্রগাঢ় বিশ্বাসে বারংবার ঘোষণা করিতেছেন, যাহা করিয়াছেন অত্যন্ত ন্যায়সম্মত ভাবে করিয়াে, ছন এবং ততোধিক প্রগাঢ় আশ্বাস দিতেছেন যে, আই পি এলে দুর্নীতির তদন্তও অত্যন্ত ন্যায়সম্মত ভাবেই সম্পন্ন হইবে। বি সি সি আই সভাপতির সরিয়া-দাঁড়ানো সভাপতির বিশ্বাসযোগ্যতা কোন শমীবৃক্ষে লুক্কায়িত আছে, গুরুনাথ জানিলেও জানিতে পারেন। তবে তাঁহার নিকটেও শ্বশুরমহাশয়ের আশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু, সেই বিষয়ে গভীর সন্দেহ আছে। শ্রীনিবাসন নূতন ন্যায়শাস্ত্র রচনা করিতে পারেন, বর্তমান ভারতে সমধিক জনপ্রিয় হইবে। কিন্তু আপাতত ন্যায় বা নৈতিকতা বলিতে যাহা বোঝায়, তাহাতে তিনি যাহা করিয়াছেন এবং করিয়া চলিয়াছেন তাহা সম্পূর্ণ অন্যায় এবং অনৈতিক। তিনি নিজে কোনও দুর্নীতিতে সরাসরি জড়িত আছেন কি না, তাহার সন্ধান তদন্ত কমিটি করিবে, অন্তত করা উচিত। দোষী প্রমাণিত হইলে তাঁহার শাস্তি বিধেয় হইবে। কিন্তু তাহা তো আইনের ব্যাপার। নৈতিকতা আইনের ঊর্ধ্বে। নিকট আত্মীয় এবং, স্পষ্টতই, সহযোগীর বিরুদ্ধে গর্হিত অপকীর্তির অভিযোগ উঠিবার পরে তাঁহার একমাত্র নৈতিক কর্তব্য ছিল অবিলম্বে পদত্যাগ। তাহাই নৈতিকতার শর্ত।
ন্যূনতম শর্ত। নৈতিকতা দাবি করিবে, ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের কর্ণধার বা তাঁহার কোনও ঘনিষ্ঠ জনের আই পি এল-এর সহিত কোনও ধরনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকা উচিত নহে। থাকিলেই ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টরেস্ট’ বা স্বার্থদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ন্যায়ের পথে থাকিতে চাহিলে স্বার্থদ্বন্দ্বের কোনও সম্ভাবনাই রাখিতে নাই। শ্বশুর, জামাতা এবং তাঁহাদের সমস্ত স্বজন ও সহকর্মীরা প্রত্যেকে মূর্তিমান যুধিষ্ঠির হইলেও রাখিতে নাই। অথচ ভারতীয় ক্রিকেটে স্বার্থদ্বন্দ্বের বিষনদী সহস্রধারায় বহিতেছে, বোর্ড প্রেসিডেন্ট হইতে জাতীয় দলের অধিনায়ক, প্রবল উৎসাহে সেই নদীতে স্নান করিতেছেন। কেহ স্নাতক স্তরে, কেহ বা স্নাতকোত্তর। তাহার সহিত যুক্ত হইয়াছে রাজনীতির নিজস্ব অবদান। এমনকী যে রাজনীতিকদের সম্মুখে এই সঙ্কট একটি যথার্থ শুদ্ধির কাজে নামিবার সুযোগ আনিয়া দিয়াছিল, যে সুযোগ কাজে লাগাইলে তাঁহাদের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হইত, তাঁহারাও দৃশ্যত নানাবিধ ক্ষুদ্র লাভক্ষতির হিসাব কষিয়া সকল আবর্জনা জাজিমের নীচে পাঠাইয়া ঊর্ধ্বনেত্র হইলেন। অরুণ জেটলি জানাইয়াছেন, সমস্যার ভাল সমাধান হইয়াছে। জেটলি দক্ষ আইনজীবী। ভাল উকিলের যুক্তির অভাব হয় না। তদন্ত শেষ না হওয়া অবধি বোর্ড সামলাইবেন জগমোহন ডালমিয়া, ইহার তাৎপর্য বুঝিতেও দিব্যদৃষ্টির প্রয়োজন নাই। ভরত রামের পাদুকা সিংহাসনে রাখিয়া রাজ্যপাট সমালাইয়াছেন। ডালমিয়ার সে প্রয়োজন হইবে না, শ্রীনিবাসন বনবাসে যান নাই, সরিয়া দাঁড়াইয়াছেন মাত্র।
এই ঘটনাবলির তাৎপর্য ক্রিকেটের বাইশ গজে সীমিত থাকিতে পারে না। বি সি সি আই একটি স্বশাসিত সংস্থা। উপমহাদেশে ক্রিকেট-বিনোদনের বিপুল সাফল্য এবং তজ্জনিত বৈভবের কারণে সংস্থাটি গুরুত্বপূর্ণ। এমন একটি সংস্থা নিজের যাবতীয় কার্যকলাপ সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনা করিবে, ইহা কেবল সেই সংস্থার স্বার্থে জরুরি নয়, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বার্থেই জরুরি। গণতন্ত্রের শক্তি ও স্বাস্থ্য বিশেষত নির্ভর করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অন্তর্নিহিত শক্তির উপর। প্রতিষ্ঠানগুলি রাষ্ট্রের নির্দেশনা বা নিয়ন্ত্রণ ছাড়া আত্মশক্তিতে ন্যায়সম্মত পথে সুস্থিত থাকিলে গণতন্ত্র সুরক্ষিত থাকে। তাহা না হইলে প্রশাসন বা বিচারবিভাগ প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করিতে আগাইয়া আসে, জনমানসে সেই হস্তক্ষেপের যুক্তিও তৈয়ারি হয়: হস্তক্ষেপ না করিয়া আর উপায় কী? কিন্তু যত ‘যুক্তি’ই থাকুক, এই ধরনের হস্তক্ষেপ অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বি সি সি আইয়ের ক্ষেত্রে তেমন দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি ঘটিবে কি না, তাহা বলিবার সময় এখনও আসে নাই। কিন্তু তেমন একটি আশঙ্কার ক্ষেত্র যে প্রস্তুত হইয়াছে, ইহাই যথেষ্ট উদ্বেগজনক। |