মাধ্যমিকের পর এ বার উচ্চমাধ্যমিকেও সেরার তালিকায় পূর্বস্থলীর এক স্কুল। নীলমণি ব্রহ্মচারি ইনস্টিটিউশন থেকে ৪৬৯ নম্বর পেয়ে যুগ্ম পঞ্চম হয়েছে মৈনাক ঘোষ। ছোট বেলায় এক বার ভর্তি হয়েছিল নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে। কিন্তু চার দিনও কাটেনি। গ্রামের স্কুলের কথা খুব মনে পড়ত তার। তাই ফিরে এসেছিল পুরনো স্কুলেই।
মাধ্যমিকে পূর্বস্থলীর সৌরাশিস বিশ্বাসের যুগ্ম প্রথম হওয়ার পর এ বার উচ্চমাধ্যমিকেও রাজ্যে মেধা তালিকায় খবরের শিরোনামে এল পূর্বস্থলী। সেরার তালিকায় নিজের নাম তোলার সঙ্গে সঙ্গে ১২৭ বছরের পুরনো পূর্বস্থলী নীলমণি ব্রহ্মাণি ইনস্টিটিউশনের নাম সবার সামনে এনেছে মৈনাক। তার প্রাপ্ত নম্বর অঙ্কে ১০০, কেমিস্ট্রিতে ৯৯, জীবনবিজ্ঞানে ৯১, ইংরেজিতে ৮৮ এবং বাংলায় ৮৭।
|
মৈনাক ঘোষ।
নিজস্ব চিত্র। |
তবে উচ্চমাধ্যমিকে যুগ্ম পঞ্চম হয়েছে বলে সারা দিন বই নিয়ে বসে থাকত না সে। তার দৈনন্দিন রুটিনের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে খেলা। বার্সেলোনা আর মেসির ভক্ত মৈনাক অবশ্য এখন খেলার পিছনে বেশি সময় দিতে পারেনা। তাঁর কথায়, “মাধ্যমিকের পরে খেলার সময়টা অনেকটা কমে গিয়েছে। এত বেশি স্যারের কাছে টিউশন পড়তে হয়, যে তার জন্য সময়টা খুব নির্দিষ্ট। তবে ফুটবল আর ভলিবলের মধ্যে একটা না খেললে মনটা ভাল লাগত না।” খেলা খুব প্রিয় হলেও, সিনেমা অবশ্য তেমন পছন্দ নয় মৈনাকের। সেই তুলনায় বরং ভালবাসে কুইজ। মৈনাক বলে, “সিনেমা নিয়ে আমার আগ্রহ খুব কম। বরং আমার ভাল লাগে কুইজ। আমি আর সৌরাশিস কুইজ পার্টনার।”
পূর্বস্থলীর বৈদিকপাড়ায় সৌরাশিসের বাড়ির একটি বাড়ি পরেই মৈনাকের বাড়ি। বাবা মদন ঘোষ ওই স্কুলের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক। মা মৌসুমি পালঘোষ পাশ্ববর্তী সাবিত্রী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। স্কুলে অঙ্ক করান তিনি। এ দিন মৌসুমী দেবী বলেন, ‘‘আমি কিন্তু কখনওই ওকে অঙ্ক করাইনি। পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই উৎসাহ দিতাম ওকে। বাবার কাছেই পদার্থবিদ্যা পড়ত ও।”
জয়েন্টে মেডিক্যালে পাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী দেখায় মৈনাকককে। বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায় সে। কেন? চুপ করে থাকে সে। মা মৌসুমীদেবী বলেন, “ছোট থেকেই কারও জন্য কিছু করতে পারলে খুব আনন্দ হয় ওর। জীবজন্তু পুষতে খুব ভালবাসে। আমরা চাই, ও ডাক্তার হোক। গ্রামে এসে চিকিৎসা করুক। আর সপ্তাহে এক দিন বিনা পয়সায় দুঃস্থ মানুষের চিকিৎসা করুক।” ছেলের সাফল্যে খুশি বাবাও। তিনি বলেন, “মাধ্যমিকে দশম হয়েছিল। আরও ভাল ফল করতে পারত। ওর নিজেরও তেমন আশা ছিল। আর একটু বেশি নম্বর।”
কতটা পরিশ্রম রয়েছে মৈনাকের এই সাফল্যের পিছনে? সে বলে, “নিয়মিত স্কুলে যেতাম আমি। টেস্টের আগে নিজের পড়ার জন্য তিন ঘণ্টা বেশি সময় পেতাম। তবে টেস্টের পরে যখন আর স্কুল রইল না, টিউশনের চাপও অনেকটা কমে গেল, তখন দিনে ন’ দশ ঘণ্টা পড়াশোনা করতাম। নিজের এই পড়াটা ভাল ফলের জন্য খুবই জরুরি।”
১৮৮৭ সাল থেকেই ইতিহাসের সাক্ষী কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কর্তা উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর বাবা নীলমণি ব্রহ্মচারীর নামাঙ্কিত এই স্কুল। তবে এমন ঘটনা স্কুলের ইতিহাসে এই প্রথম। স্কুলের প্রধান শিক্ষক তপন মণ্ডল বলেন, “মৈনাক যেমন নিজের পড়াশোনা নিয়ে অত্যন্ত সচেতন, তেমনই স্কুলের শিক্ষকেরাও খুব পরিশ্রমী। আর তার জন্যই স্কুলে ৯৫ শতাংশের বেশি উপস্থিতি ছিল মৈনাকের মতো মেধাবী পড়ুয়ার। ওর জন্য আমরা গর্বিত।”
মৈনাকের জন্য গর্বিত পাশের বাড়ির সৌরাশিসও। দুপুরেই অনেকের সঙ্গে মৈনাকের সঙ্গে দেখা করতে আসে সে। দেখা হতেই ঝাঁকুনি দিয়ে হাত মেলায়। বলে, “আজ একটা অন্য রকম ভাল লাগা কাজ করছে। দারুণ করেছে মৈনাকের।” চিত্র সাংবাদিক দু’জনকে একসঙ্গে ফ্রেমবন্দী করতে চাইলে বলে ওঠে, “আজ আমার নয়। মৈনাকদার দিন।” |