প্রথম দফার ৯টি জেলায় মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া চলছে। দ্বিতীয় দফার ৪টি জেলার ভোটের বিজ্ঞপ্তিও জারি হয়ে গিয়েছে। তবুও বাহিনী বিভ্রাটের জেরে পঞ্চায়েত ভোটের জট কাটছে না। মনোনয়ন জমা দেওয়াকে ঘিরে জেলায় জেলায় সংঘর্ষও অব্যাহত।
পঞ্চায়েত ভোটের নিরাপত্তা নিয়ে আদালতের কাছে জবাবদিহির আগে কমিশন ও রাজ্য উভয় পক্ষই চিঠি চালাচালি জারি রেখেছে। কিন্তু নিরাপত্তা বন্দোবস্ত নিয়ে সমাধান সূত্র খুঁজতে শনিবার কমিশনের ডাকে যাননি স্বরাষ্ট্রসচিব। কারণ, এখনও অন্য রাজ্য বা কেন্দ্রের কাছ থেকে বাহিনী পাওয়ার আশ্বাস মেলেনি। সেই দায় ঝেড়ে ফেলতে স্বরাষ্ট্র দফতর চিঠি দিয়ে কমিশনকে বলেছে, ভোটের দিন ঠিক করতে কমিশন অযথা দেরি করার ফলেই বাহিনী চাইতে বিলম্ব হয়েছে। এখন বাইরের পুলিশ না-পেলে তার দায় রাজ্যের নয়। সব মিলিয়ে বাহিনী প্রশ্নে জল ফের আদালতে গড়াতে পারে বলেই আইন বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
পঞ্চায়েত ভোটের জন্য ৩০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছে রাজ্য। ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ এবং পঞ্জাব থেকে চাওয়া হয়েছে আরও ১৩০ কোম্পানি। কিন্তু শনিবার সন্ধে পর্যন্ত কোথা থেকেও জবাব আসেনি। অথচ ভোটের দিন যত এগোচ্ছে, ততই তপ্ত হচ্ছে রাজ্য। এ দিনও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বর্ধমান, দুই মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। তাই এ দিন মহাকরণ থেকে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। কিন্তু সেখানে শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য সব ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও নিরাপত্তা বাহিনী প্রসঙ্গে মহাকরণের তরফে কিছুই জানানো হয়নি। তড়িঘড়ি কেন এই বৈঠক ডাকা হল, তার উত্তরও প্রশাসনের কর্তাদের কাছে নেই।
মহাকরণ সূত্রের খবর, সকাল ১০টায় বৈঠক শুরু হয়। দশ মিনিটে শেষ হয়ে যায়। ডিএম, এসপি-রা ভোটের প্রস্তুতি-আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে মুখ্যসচিবকে বিভিন্ন তথ্য জানাবেন বলে প্রস্তুত হয়ে থাকলেও, কোনও প্রশ্ন করার বা মত জানানোর সুযোগ পাননি। মিনিট পাঁচেকের বক্তব্যে মুখ্যসচিব জানিয়ে দেন, রাজ্য চায় অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট। তাই জেলাশাসকদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে বলেন তিনি। প্রশাসনের একটি মহল জানাচ্ছে, ভোটের প্রথম দফার মনোয়ন জমা নেওয়া শুরু হলেও এখনও পর্যন্ত কোথাও বড় সংঘষের্র ঘটনা ঘটেনি বলে তিনি এ দিন ডিএম, এসপি-দের ধন্যবাদও জানান।
কিন্তু বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচন কমিশন যখন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে দাবি করছে, জেলাশাসক থেকে পুলিশ প্রশাসন এখন তাদের অধীনে। তখন রাজ্য এ ভাবে ডিএম, এসপি-দের সঙ্গে বৈঠক করতে পারে কি না? কমিশনের এক মুখপাত্র জানাচ্ছেন, ভোটের কাজ ছাড়াও জেলাশাসকদের প্রশাসনিক অন্যান্য কাজও থাকে। সেই সব কারণে রাজ্য বৈঠক করতেই পারে। পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে রাজ্য বৈঠক করেছে কি না তা কমিশনের কিছু জানা নেই। তবে বাহিনী নিয়ে ক্রমশ ক্ষোভ বাড়ছে কমিশনে। শুক্রবারই সেই ক্ষোভ প্রকাশ করে রাজ্যকে চিঠি লিখেছিল কমিশন। বাহিনী নিয়ে বৈঠকের জন্য স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডেকেছিলেন নির্বাচন কমিশনার। কিন্তু অন্য কর্মসূচি থাকায় যেতে পারবেন না বলে জানান বাসুদেববাবু। কবে তিনি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করবেন, তা-ও কমিশনের কর্তারা কিছু জানেন না।
স্বরাষ্ট্রসচিব না-গেলেও বাহিনী মোতায়েন প্রসঙ্গে কমিশনকে জবাব দিয়েছে রাজ্য। কড়া বার্তায় মহাকরণ লিখেছে, ভোটের জন্য কোনও রাজ্যের কাছ থেকে বাহিনী চাইতে হলে ভোটের দিনক্ষণ জানাতে হয়। কমিশন সেপ্টেম্বরে বাহিনী আনার কথা বললেও ভোটের দিন ঘোষণা করতে বহু দেরি করেছে। ফলে ভিন্ রাজ্য বা কেন্দ্রকে বাহিনীর জন্য অনুরোধ জানানো সম্ভব হয়নি।
কিন্তু ভোটে কী ভাবে বাহিনী মোতায়েন করতে হবে, তার স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। গরমের ছুটির পর সোমবার আদালত খুলছে। সে দিনই বাহিনী মোতায়েন থেকে পুলিশ-প্রশাসনের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ সর্ম্পকিত বক্তব্য প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের কাছে জানাতে পারে কমিশন। সে জন্য কমিশনের আইনজীবী সমরাদিত্য পালের সঙ্গে পরামর্শও শুরু করেছেন নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে।
প্রশাসনের একটি মহল বলছে, ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ মতো বাহিনী প্রসঙ্গে কমিশনকে এখনও আশ্বস্ত করতে পারেনি। রাজ্য এবং কমিশনে ফের আইনি লড়াই শুরু হতে পারে বলেই অনেক বিশেষজ্ঞের মত।
কমিশন সূত্রের খবর, প্রথম দফার ভোটের মনোনয়নপত্র জমার প্রথম দিন থেকে এ দিন দুপুর পর্যন্ত গ্রাম পঞ্চায়েতে ২০ হাজার ৩৮৫টি মনোনয়ন জমা পড়েছে। যার মধ্যে সিপিএমের ৯,০৩৪টি। তৃণমূলের ৬,৭৮২টি। ফলে বিরোধী দলগুলো ভয় দেখিয়ে মনোনয়ন জমা দিতে না-দেওয়ার যে অভিযোগ তুলছে তা নস্যাৎ করে তৃণমূল নেতা মুকুল রায় বলেন, “ভোটের দিন ঘোষণার পর থেকে তৃণমূল কর্মীরাই রক্তাক্ত হচ্ছে। কিন্তু বিরোধীরা এমন বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা করছে যে আমরা যেন ভোট চাইছি না। হার নিশ্চিত জেনে বিরোধীরা নোংরা খেলায় নেমেছে। তাদের মদত দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন।”
বিরোধীরা অবশ্য শাসক দলের বিরুদ্ধে শাসানির অভিযোগে অনড়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ে ব্লক দফতরে মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে তাঁর দলের কর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন জানিয়ে সেখানে ভোট স্থগিত রাখার আর্জি জানান প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। বলেন, “কোনও দলই যাতে আক্রান্ত না হয়, তাই কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছিলাম। ওঁরা (তৃণমূল নেতৃত্ব) বিরোধিতা করেছেন।”
সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “মনোনয়ন তুলতে বা জমা দিতে গিয়ে বাম প্রার্থীরা আক্রান্ত হয়েছেন।” বিজেপি নেতা রাহুল সিংহ নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি দিয়ে সর্বত্র বিডিও, এসডিও এবং জেলাশাসক তিন আধিকারিকের দফতরেই মনোনয়ন তোলা এবং জমার ব্যবস্থা রাখার আর্জি জানিয়েছেন। তাঁর প্রশ্ন, বাহিনীর ব্যাপারে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে তথ্য না-পাওয়া সত্ত্বেও কমিশন কেন ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি করল? রাহুলবাবুর দাবি, মনোনয়ন পেশে বাধা ঠেকাতে কমিশন সর্বদল বৈঠক ডাকুক। সমস্যা না-মিটলে কমিশনের দফতর ঘেরাও করারও হুমকি দেন রাহুলবাবু। |