দেশটা তেমন মন্দ নয়। জনবসতি নেই বললেই চলে। চারিদিকে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলে এক-আধটা বাঘও আছে। তা ভূতের আবার বাঘের ভয়। চারিদিকে এই যে ঘন জঙ্গল আর ভয় মাখানো গা-ছমছমে অন্ধকার এ সবই তো প্রিয় ভূতেদের। আর সে জন্যই তো সাত রাজ্যের ভূতেরা এসে জুটছে এখানে। শ্যাওড়া বলো, আম বলো, আর জাম বলো কোনও গাছই আর খালি নেই। সবখানে আর সব গাছেতেই ভূতেদের বাসা।
ভূতেদের দেবতা শিব এই জায়গাটার মাহাত্ম্য বুঝতে পেরে শাসনকার্য পরিচালনা করতে সুবিধা হবে এই অজুহাতে কৈলাস থেকে নেমে বহু দিন আগেই এখানে ঘাঁটি গেড়েছেন। ভূতেদের দিয়ে দু’দুটো কাছারিও তৈরি করে নিয়েছেন। একটার নাম দিয়েছেন বড় কাছারি আর একটার নাম দিয়েছেন ছোট কাছারি। নামেই কাছারি। বিচার হয় না, বাবা তার চেলাদের নিয়ে
নেশা-ভাঙ করেন আর দিন রাত
ধেই ধেই করে নাচেন। গেল হপ্তায় কোন এক যাত্রাদল যাচ্ছিল বঁড়শেতে। বাবার চেলাদের সাধ হল যাত্রা দেখবে। বাবাকে তারা তাদের মনের কথাটা বলতেই বাবা নিমেষের মধ্যে চেলাদের ভদ্রলোক বানিয়ে দিলেন। তার পর নিজেও ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ভদ্রলোক সেজে চললেন যাত্রাদলকে ধরতে।
তখন সবে সন্ধে হয়েছে। অন্ধকারে যাত্রাদলের লোকেরা গুলিয়ে ফেলেছে বঁড়শের পথ। বাবা তাদের পথ আগলে বললেন, আসুন, আসুন। আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছি আমরা।
তারা ভাবল, সত্যিই তো! ওই তো মঞ্চ বাঁধা, আলো জ্বলছে। কয়েকশো ভদ্রস্থ গৃহস্থ দর্শকও জুটেছে। আমরা কিনা বঁড়শে ছেড়ে চলেছি বঁড়শের খোঁজে।
সারারাত যাত্রা হল। যাত্রাশেষে বাবা তাদের বিশ্রামের সুব্যবস্থা করে দিলেন। কোল বালিশ, লেপ, তোষক যা তারা কল্পনাও করেনি, সবই পেল। কিন্তু সকাল হতেই যেই তাদের ঘুম ভেঙেছে, দেখে কী শ্মশানে শুয়ে আছে! মড়ার খুলি আর মড়ার হাড়গোড়ের বিছানায়। সে এক মজার কাণ্ড বটে! কিন্তু যার হাতে শাসনভার, সে যদি এমন হাসি-তামাশা করে কাটিয়ে দেয় প্রজাদের যে সাড়ে সর্বনাশ হবেই। হয়েছেও তা-ই। কোথা থেকে এক ওঝা এসে ঘাঁটি গেড়েছে রায়গড়ে। সকাল হতে না হতেই কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
|
ও দিকে ব্যায়লা আর এ দিকে ময়না বোষ্টমীর গোর সবখান চিল্লে চিল্লে দাওয়াই বিক্রি করে।
বলে, দাওয়াই লাগবে, দাওয়াই? ভূত তাড়াবার অব্যর্থ দাওয়াই? গোপেশ্বরের মন্ত্রপূত দাওয়াই? সাদা ভূত বারো চিমটে। কালো ভূত তিন চিমটে। রাতে শুতে যাওয়ার আগে বাড়ির সামনে ছড়িয়ে দেবেন। তিন মাইল দূর পর্যন্ত ভূত থাকলে জ্বলুনির জ্বালায় পালাবে। দাম মাত্র ছয় কড়ি।
মানুষের হাজারো দোষের মধ্যে মহাদোষ হল অকারণে ভয় পাওয়া। ভূত মানুষের কোনও অনিষ্ট না করলেও মানুষের ভূতের ভয় সাঙ্ঘাতিক। আহা! গরিব মানুষ যারা কিনা চাষাবাদ করে খায়, গামছা পরে থাকে, তারাও ছয় কড়ি খরচ করে দাওয়াই কিনছে। ভূতেরা আর কত দিন সহ্য করবে এ সব? তারা ঠিক করেছে এর একটা শেষ দেখে ছাড়বে।
হয় রায়গড়ে ভূত থাকবে, নয়তো ভূতের ওঝা গোপেশ্বর।
তারা দল বেঁধে গেল বড় কাছারিতে। বাবা বড় কাছারি সব শুনে বললেন আমি শুধু ভূতের দেবতা নই, মানুষেরও দেবতা। মানুষেরা ফলমূল দিয়ে খুব ঘটা করে পুজো করে আমার। আমি মানুষের বিরুদ্ধে যেতে পারব না। ওঝাগিরি পেশা হলে ভূত তাড়িয়েই তাকে খেতে হবে। জীবের মুখ থেকে আহার কেড়ে নেওয়া আমার কম্ম নয়।
বাবা বড় কাছারি অর্থাৎ শিবের কথায় তাদের বুঝতে আর বাকি রইল না, বাবা তাদের এ বিষয়ে কোনও সাহায্য করবেন না। তারা ঠিক করল যে ভাবে তারা পাঁচু ওঝাকে তাড়িয়েছিল রায়গড় থেকে সে ভাবেই গোপেশ্বরকেও তাড়াবে। গোপেশ্বরের গোয়ালের গরু, ছাগল, মোষ, ইঁদুর সব ক’টার ঘাড়ে চেপে বসে জ্বালাতন করবে।
পাঁচু ওঝা আর গোপেশ্বর তো এক নয়। গোপেশ্বর হল গিয়ে গোপেশ্বর। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘর বন্ধন করে। রাতে শুতে যাওয়ার আগে নিজের তৈরি দাওয়াই নিজেই ব্যবহার করে।
তারা ঠিক কায়দা করে উঠতে পারল না। শেষে তারা ঠিক করল সম্মুখ সমরে নামবে।
সে দিন গোপেশ্বর প্রতিদিনের মতো তার ঝোলা নিয়ে বেরিয়েছে। কিছুটা এগিয়ে দেখল বাঁশবাগানের পিছনে ছায়া-ছায়া কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে। না-দেখার ভান করে সে এগিয়ে গেল। হঠাৎ গাব গাছ থেকে একটা ঠ্যাং ঝুলে পড়ল তার সামনে। গোপেশ্বর মাথা তুলে দেখল। একটা মামদো ভূত। চোখ নাচিয়ে তাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে।
গোপেশ্বর ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, গোপেশ্বর ওঝার সঙ্গে লড়তে একা এসেছিস? পারবি তো?
সঙ্গে সঙ্গে তাল, শ্যাওড়া, আমড়া, বট, অশ্বত্থ আশপাশের সব ক’টা গাছ থেকে ঠ্যাং ঝুলিয়ে ভূতেরা গান ধরল,
এ বার গোপে তোমায় খাব
গরম গরম তেলে ভেজে
লঙ্কা চিরে নুন ছড়িয়ে...।
গোপেশ্বর দমল না, ভয়ও পেল না। বলল, ফাজলামো হচ্ছে। আমার ঝোলাতে কী আছে জানিস? দেব ছড়িয়ে? তোদের ভূত সমাজে মহামারী শুরু হয়ে যাবে!
এ কথা শোনার পর যুদ্ধ করার কথা ভুলে ভূতেরা যে যে দিকে পারল ছুটে পালাল।
তার পর ভূতেরা আর টুঁ শব্দটি করল না। শুধু গোপনে গোপনে খুঁজে চলল গোপেশ্বরকে জব্দ করার উপায়। সবাই খুঁজছে গোপেশ্বরকে জব্দ করার উপায়, কিন্তু এক জনই কেমন যেন উদাস। এ সব নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। সেই যে বাবার সঙ্গে বসে যাত্রা দেখেছে তার পর থেকে সে শুধু সেই পালা নিয়েই ভাবে। আপন মনেই কথা বলে। আপন মনেই হাততালি দেয়।
ভূতেদের সর্দার এক দিন তাকে বলল, নন্দলাল, ভূত সমাজের এই মহাবিপদে তুই কি কিছুই ভাববি না?
নন্দলাল বলল, বিপদ কোথায় জাঁহাপনা। এ তো এক তুচ্ছ ছারপোকা!
ভূতেদের সর্দার অবাক, কী বলিস রে?
নন্দলাল বলল, বাবা আমাকে এমন একটা মন্ত্র দিয়েছে, যার বলে আমি যে কোনও মানুষের রূপ ধারণ করতে পারি। এই দেখ আমি নন্দলাল হয়ে গেলাম গোপেশ্বর ওঝা! এই দেখ আমার হাতের তেঁতুলপাতা হয়ে গেল গোপেশ্বরের দাওয়াই। আমি এখন গোপেশ্বর সেজে তেঁতুলপাতা বিক্রি করতে বেরব। তোমরা আমার পিছনে পিছনে এসো। যে কিনবে তার বাড়ি চিনে রাখবে। রাতে গিয়ে উৎপাত করবে সেখানে। ...দাওয়াই লাগবে, দাওয়াই? ভূত তাড়াবার অব্যর্থ দাওয়াই?...
গোপেশ্বরকে তাড়াবার এত সহজ পথটাই জানা ছিল না কারও। সবাই তাজ্জব নন্দলালের বুদ্ধি দেখে। প্রতিদিন নন্দলাল গোপেশ্বর সেজে দাওয়াই বিক্রি করে। যারা যারা সে দাওয়াই কেনে, ভূতেরা রাতের বেলা তাদের বাড়িতেই বেশি বেশি করে উৎপাত করে।
এক মাসও গেল না। প্রথমে ব্যায়লার লোকজনেরা ঠগ-জোচ্চোর বলে পেটাল গোপেশ্বরকে। তার পর এক দিন বঁড়শের লোকজনেরা। কথাটা শেষে উঠল রাজা বসন্ত রায়ের কানে। রাজা বসন্ত রায় বললেন, তোমার আর এ দেশে থাকা হবে না গোপেশ্বর। তোমার লোক ঠকানো কারবার গুটিয়ে অন্য দেশে পাড়ি দাও। নইলে আমার মাথায় এক বার রাগ চড়লে...।
কী আর করে বেচারা গোপেশ্বর। পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে পরিবার নিয়ে চেপে বসল গরুর গাড়িতে। কোথা থেকে আর কী ভাবে এ সব হল ভাবার সময় নেই তার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে এ দেশ
ছেড়ে চলে যেতে হবে, নইলে
রাজা বসন্ত রায়ের রাগ মাথায় চড়তে আর কতক্ষণ! |