আদতে খরচ যা ধরা হয়েছিল, তার উপরে প্রায় ৭০% বাড়তি অর্থের দাবি করে বসেছে নির্মাতারা। আর সেই অতিরিক্ত বরাদ্দ মঞ্জুরি নিয়ে নানাবিধ প্রশাসনিক জটে পড়ে মাঝপথে থমকে রয়েছে পার্ক সার্কাস-পরমা আইল্যান্ড উড়ালপুলের কাজ। প্রকল্প কবে শেষ হবে, তার কোনও ইঙ্গিত মিলছে না প্রশাসনের কোনও মহল থেকে।
উড়ালপুল নির্মাণের সূচনায় পুরো প্রকল্পের খরচ নির্ধারিত হয়েছিল ৩১৭ কোটি টাকা। কাজ কিছুটা এগোতেই নির্মাতা সংস্থা আরও ২২৬ কোটি বরাদ্দের দাবি জানিয়েছে, যা নিয়ে মাথা চাড়া দিয়েছে কিছু প্রশ্ন ও অভিযোগ। বাড়তি বরাদ্দ অনুমোদনের ফাইল আপাতত অর্থ দফতরে থাকলেও এর যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখতে মুখ্যসচিব ইতিমধ্যে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গড়ে দিয়েছেন। কথা ছিল, পূর্ত-সচিবের নেতৃত্বাধীন সেই কমিটি মে মাসের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। কিন্তু রিপোর্ট তৈরি হতে আরও কিছু দিন সময় লাগবে বলেই মহাকরণ-সূত্রের ইঙ্গিত।
এ দিকে বাড়তি অর্থের নিশ্চয়তা না-পাওয়ায় গত ক’মাস উড়ালপুলের কাজ কার্যত বন্ধ রেখেছে নির্মাতারা। কবে কাজ ফের শুরু হতে পারে, প্রশাসনের কর্তারা সে ব্যাপারে কোনও দিশা দিতে পারছেন না। রাজ্যের পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম অবশ্য বলেছেন, “দরকার হলে কেএমডিএ-র জমি বেচে ২২৬ কোটি টাকা তুলে দেওয়া হবে।” উল্লেখ্য, রাজ্যের তরফে নগরোন্নয়ন দফতরই প্রকল্পটির দায়িত্বে। কেএমডিএ তাদের নোডাল এজেন্সি হিসেবে কাজ করছে।
কলকাতার দীর্ঘতম ওই উড়ালপুলটি নির্মাণের বরাত ২০১০-এ হিন্দুস্থান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (এইচসিসি)-র হাতে দেওয়া হয়েছিল। রাজ্যে তখন বাম জমানা। স্থির হয়, কেন্দ্রীয় জেএনএনইউআরএম এবং রাজ্যের টাকায় সেতু তৈরি হবে। চুক্তি অনুযায়ী তিরিশ মাসের মধ্যে নির্মাণ সেরে ফেলার কথা ছিল। পরে সময়সীমা চলতি বছরের ৩১ অগস্টে টেনে আনা হয়েছে। কেন? |
সরকারের এক মুখপাত্রের ব্যাখ্যা: কাজে নেমে দু’টি সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছিল। প্রথমত, ইএম বাইপাসের চার নম্বর ব্রিজ থেকে পার্ক সার্কাসের মধ্যে রাস্তার ঠিক মাঝ বরাবর ভূগর্ভে একশো বছরের পুরনো ইটের নিকাশি লাইনের হদিস মেলে, যা সরালে মহানগর অচল হয়ে পড়বে বলে জানায় কলকাতা পুরসভা। তাই পিলারের জায়গা বদলাতে নকশায় পরিবর্তন করতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, উড়ালপুলের কাজ চালানোর জন্য বাইপাসের ব্যস্ত অংশটি অধিকাংশ সময়ে ‘ফাঁকা’ পাওয়া যায়নি। ফলে প্রকল্পের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে। তাতে প্রকল্প-ব্যয়ও বেড়ে গিয়েছে, যে কারণে এইচসিসি ২২৬ কোটি টাকা বাড়তি চেয়েছে বলে জানিয়েছেন মুখপাত্রটি। কেএমডিএ-ও তাদের দাবি অনুমোদন করে অতিরিক্ত বরাদ্দ মঞ্জুরের জন্য অর্থ দফতরে ফাইল পাঠিয়েছে।
সেই অনুমোদন ঘিরেই প্রশ্ন উঠেছে। কী রকম? মহাকরণ-সূত্রের খবর: সরকারি নিয়মানুযায়ী কোনও প্রকল্পের খরচ দশ শতাংশের বেশি বাড়লে নতুন দরপত্র ডাকতে হয়। কিন্তু এইচসিসি ৭০% বাড়তি অর্থের দাবি পেশ করার পরে, গত ১০ অক্টোবর নগরোন্নয়নমন্ত্রী বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেন, প্রকল্পটি দ্রুত রূপায়ণের স্বার্থে নতুন করে দরপত্র চাওয়া হবে না, কাজ এইচসিসি-ই করবে। তবে বাড়তি অর্থ অনুমোদনের জন্য অর্থ দফতরে ফাইল পাঠানো হবে। প্রস্তাবটি নিয়ে বৈঠকে বসে কেএমডিএ-র টেন্ডার কমিটি, যার আহ্বায়ক নগরোন্নয়ন-সচিব। কমিটিতে রাজ্যের অর্থ-সচিবও রয়েছেন। তাঁরাও ওই সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়ে কেএমডিএ-র পরিচালন কমিটি ও অর্থ দফতরে ফাইল পাঠানোর সুপারিশ করেন। শেষে কেএমডিএ-র পরিচালন কমিটির বৈঠকে (এর চেয়ারম্যান স্বয়ং নগরোন্নয়নমন্ত্রী) স্থির হয়, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য অর্থ দফতরে ফাইল পাঠানো হবে।
তা-ই হয়েছে। কিন্তু দরপত্র ছাড়াই কী ভাবে বাড়তি ২২৬ কোটি বরাদ্দের ছাড়পত্র দেওয়া হল, সে প্রশ্ন তুলে ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়নমন্ত্রী কমলনাথ ও রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে চিঠি দিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ সোমেন মিত্র। তাঁর অভিযোগ: বাড়তি বরাদ্দের মাধ্যমে বেসরকারি নির্মাতাকে নিয়ম-বহির্ভূত ভাবে টাকা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। নগরোন্নয়ন দফতরের এক শীর্ষকর্তার বিরুদ্ধেও আঙুল তোলেন তিনি। পরে সোমেনবাবু বলেন, “আমার কাছে যে তথ্য ছিল, তার ভিত্তিতেই চিঠি দিয়েছি। সরকার তো আমাকে জানায়নি যে, অভিযোগ সত্যি না মিথ্যে!”
সরকারের বক্তব্য কী?
নগরোন্নয়নমন্ত্রী অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছেন। “এইচসিসি-র দাবি অযৌক্তিক মনে করি না। কারণ, ওদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া যায়নি, নক্শা বদলাতে হয়েছে। তাই সময়ে কাজ শেষ হয়নি। আমাদের গাফিলতি রয়েছে। পূর্ত-সচিবের কমিটি-ই বলুক, আমাদের সিদ্ধান্ত যথাযথ কি না।” মন্তব্য ফিরহাদের। কিন্তু নতুন টেন্ডার
ছাড়া বাড়তি এত টাকার বরাত দেওয়া যায় কি?
মন্ত্রীর ব্যাখ্যা, “আমি তো একা সিদ্ধান্ত নিইনি! এ জন্য অফিসার, ইঞ্জিনিয়ার-সহ গোটা একটা কমিটি ছিল। মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে
চূড়ান্ত অনুমোদন আমাকেই দিতে হয়েছে।” মন্ত্রীর আরও যুক্তি, “নির্মাতা সংস্থার সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ
হয়নি। তাই মামলাও হয়ে যেতে পারত। সব ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত
নিতে হয়েছে।” নগরোন্নয়ন-সচিব দেবাশিস সেন বলেন, “আমার যাবতীয় বক্তব্য লিখিত ভাবে মুখ্যসচিবকে জানিয়ে দিয়েছি।”
শেষমেশ বাড়তি ২২৬ কোটি খরচে রাজ্য অনুমোদন দেবে কি না, দিলেও পুরোটা মঞ্জুর হবে কি না এবং সে ক্ষেত্রে নির্মাতারা রাজি হবে কি না এমন কিছু গুরুতর প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের গর্ভে। তাই পরমা আইল্যান্ড উড়ালপুলের ভবিষ্যৎ এই মুহূর্তে কিছুটা অনিশ্চয়তায়। |