মজা করে বলতেন, এক ছেলে আর এক মেয়ের মাঝে ইনফোসিস যেন আমার মধ্যম সন্তান।
অবসরের পরে দু’বছরও কাটল না। সেই ‘মধ্যম সন্তানের’ কাছেই ফিরে এলেন নাগাবরা রামারাও নারায়ণমূর্তি।
ঠিক যেমন ফিরে এসেছিলেন স্টিভ জোবস, হাওয়ার্ড শুলজ্রা।
শনিবার সকালে দেশের অন্যতম সেরা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিস জানিয়ে দিল, সংস্থার শীর্ষ পদে ফেরানো হচ্ছে নারায়ণমূর্তিকে। এবং আজ, শনিবার থেকেই। আগামী পাঁচ বছরের জন্য তিনিই সংস্থার এগ্জিকিউটিভ চেয়ারম্যান পদে থাকবেন। ২০১১ সালের অগস্টে যাঁর হাতে দায়িত্ব সঁপে অবসর জীবনে পা রেখেছিলেন, এ দিন সেই কে ভি কামাথ নিজেই এ খবর জানিয়ে বলেন, “ইনফোসিস তো বটেই, গোটা দেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পই এখন চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এই কঠিন সময়ে সংস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়োজন অভিজ্ঞতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর দক্ষ নেতৃত্ব। সেই কারণেই নারায়ণমূর্তিকে ফিরিয়ে আনার এই সিদ্ধান্ত।”
আর তিনি নিজে, ইনফোসিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, কী বলছেন? ৬৭ বছরের নারায়ণমূর্তির কথায়, “আমার কাছে এই প্রস্তাব একেবারে অপ্রত্যাশিত। সংস্থা ছেড়ে যাওয়ার সময় স্বপ্নেও সেখানে ফেরার
কথা ভাবিনি। তা-ও আবার এগ্জিকিউটিভ চেয়ারম্যান হিসেবে! কিন্তু ইনফোসিস আমার মধ্যম সন্তান। তাই এ বারও নিজের সেরাটুকু উজাড় করে দেব আমি।” |
তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের এক বড় অংশের বক্তব্য, গত প্রায় দু’বছর ধরে সত্যিই ইনফোসিসের দশা ছিল সেই সব দস্যি ছেলের মতো, যারা বুদ্ধিমান কিন্তু বেপথু। পায়ের তলার জমি আলগা হচ্ছিল একটু-একটু করে। প্রতি বছর নিজেদের সংস্থার ব্যাপারে যে পূর্বাভাস (আগামী দিনে মুনাফা কেমন হবে, বরাত কেমন জুটবে ইত্যাদি) প্রকাশ করত ইনফোসিস, তার দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে থাকত তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প এবং শেয়ার বাজার। কিন্তু সম্প্রতি সেই পূর্বাভাস মেলাতে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছিল তারা। দ্রুত কমছিল মুনাফার হার। বাজারের দখল ছিনিয়ে নিচ্ছিল টিসিএস, কগনিজ্যান্ট, উইপ্রো, এইচসিএল টেকনোলজিসের মতো প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীরা।
স্বাভাবিক ভাবেই এই সব কিছুর প্রভাব পড়ছিল শেয়ার দরে। টানা এক দশক যে সংস্থার শেয়ার দরের রকেট গতিতে উত্থান সকলের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল, সম্প্রতি শেয়ার বাজারে তাদেরই অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছিল অনেকের। গত দু’বছরে সংস্থার শেয়ারের দর পড়েছে প্রায় ১৫%। এর উপর মন্দার ফসল হিসেবে আমেরিকা আর ইউরোপ থেকে বরাত কমার সমস্যা তো রয়েইছে।
এই চক্রব্যূহ থেকে বেরোতে শেয়ারহোল্ডাররা শীর্ষ নেতৃত্বে বদলের দাবি তুলছিলেন। এ দিন নিজের বক্তব্যে তা স্বীকারও করেছেন কামাথ। অনেকেই মনে করছেন, বাস্তব পরিস্থিতি মেনে শেয়ারহোল্ডারদের চাহিদাকে সম্মান জানাতেই সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কামাথ। ব্যক্তিস্বার্থ বা নিজের ভাবমূর্তির আগে সংস্থার ভাল নিয়ে চিন্তা করার যে ইচ্ছেকে এ দিন কুর্নিশ জানিয়েছেন স্বয়ং নারায়ণমূর্তিও।
ইনফোসিসের প্রাণপুরুষের এ ভাবে ফিরে আসার সঙ্গে স্টিভ জোবসের রাজসিক প্রত্যাবর্তনের তুলনা টানছেন অনেকে। নিজের হাতে গড়া অ্যাপল থেকে জোবস চলে যাওয়ার পর ধুঁকতে শুরু করেছিল সংস্থাটি। এক রকম বাধ্য হয়েই তাঁকে ফিরিয়ে আনে অ্যাপল। আই-পড, আই-ফোন, আই-প্যাডের হাত ধরে বাকিটা ইতিহাস। তিলে তিলে গড়ে তোলা সংস্থাকে সমস্যায় পড়তে দেখে তার রাশ ধরার জন্য ফিরে আসার নজির অবশ্য আরও রয়েছে। গুগ্লের ল্যারি পেজ, কফি চেন স্টারবাক্সের হাওয়ার্ড শুলজ্, অ্যামাজনের জেফ বেজোস প্রমুখ।
পশ্চিমের এই সব কিংবদন্তির মতো বেঙ্গালুরুর বাসিন্দার ফেরাও যে স্রেফ প্রতীকী নয়, তা স্পষ্ট তাঁর নয়া পদ থেকেই। কারণ, এগ্জিকিউটিভ চেয়ারম্যান হিসেবে সংস্থার পথনির্দেশ ঠিক করা তো আছেই, সেই সঙ্গে প্রায় সাত বছর পরে সংস্থার দৈনন্দিন কাজকর্ম আবার কিছুটা দেখবেন তিনি। পাশাপাশি এ দিন যে ভাবে ইনফোসিস এগ্জিকিউটিভ চেয়ারম্যানের অবসরের বয়স ৬০ থেকে পিছিয়ে তড়িঘড়ি ৭৫ করে দিল, তাতে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসও বেশ লম্বা হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন অনেকে। |
নিজের হাতে গড়া সংস্থার হাল ধরতে এ বার অবশ্য তিনি একা ফিরছেন না। সঙ্গে আনছেন ছেলে রোহনকেও। সরকারি ভাবে ইনফোসিস কিংবা তার নতুন কর্ণধারের দাবি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচডি রোহনের এই নিয়োগ নেহাতই সাময়িক। বাবার এগ্জিকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। কাজ, নারায়ণমূর্তিকে ইনফোসিস সামলাতে সাহায্য করা। কিন্তু সরকারি বয়ান যা-ই হোক, একে আসলে নতুন প্রজন্মের অভিষেক হিসেবেই দেখছে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের এক বড় অংশ।
এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই মনে করেন, ইনফোসিসের পরিচালন পর্ষদের বৈঠকে চেয়ারম্যান হিসেবে নারায়ণমূর্তির উপস্থিতিটুকুই বদলে দিতে পারে অনেক কিছু। অনেকটা ভারতীয় ক্রিকেটের ড্রেসিং রুমে তেন্ডুলকরের মতো। অবশ্য এর বিরুদ্ধ মতও রয়েছে। মন্তব্য আর পাল্টা মন্তব্যে ভেসে যাচ্ছে ট্যুইটার-সহ বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট। সমালোচকরা বলছেন, আসলে নিজের সাম্র্যাজ্যপাটে এ বার ছেলের অধিকার কায়েম করতে চাইছেন তিনি। কেউ মনে করছেন, এ তো অবিকল রাজনীতির মতো, যেখানে পরিবারতন্ত্রের ছায়া বড় বেশি! আবার কারও কারও প্রশ্ন, তা হলে কি ঘুরিয়ে এখনকার ইনফোসিস কর্তাদের অপদার্থ বলে মেনে নিলেন নারায়ণমূর্তি? তবে সমালোচনার এই স্রোত সরিয়ে শিল্পমহলের এক বড় অংশ মনে করছে, নারায়ণমূর্তি ফিরলে ফের আগের মতো জেট গতিতে দৌড়বে ইনফোসিস। মনোবল বাড়বে কর্মীদের। দরকারে সাহায্যের হাত বাড়াতে তৈরি থাকার কথা জানাচ্ছেন বছর কয়েক আগে সংস্থা ছাড়া মোহনদাস পাই-ও।
১৯৮১ সালে পুণেতে ছয় বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ইনফোসিস গড়ার কাজ শুরু করেন নারায়ণমূর্তি। নিজের সম্বল ছিল স্ত্রীর থেকে ধার করা ১০ হাজার টাকা। ২০১১ সালে অবসরের দিন কন্নড় স্কুল শিক্ষকের এই সন্তান জানিয়েছিলেন, মাঝের ত্রিশ বছরে ইনফোসিসকে ৭০০ কোটি ডলার ব্যবসা আর দেড় লক্ষ কর্মীর মহীরুহে পরিণত করতে গিয়ে পরিবারকে সময়ই দিতে পারেননি তিনি। এক সময়ে দিনে ১৬ ঘণ্টা বরাদ্দ থেকেছে কাজে। বছরে ৩৩০ দিন কেটেছে বাড়ির বাইরে। সুতরাং এ বার বিশ্রাম।
কিন্তু সেই বিশ্রাম পেলেন কই? অবসরের দু’বছরের মাথায় ফের সেই কাজের বৃত্তেই ফিরতে হচ্ছে তাঁকে।
সন্তান ভুল পথে যাচ্ছে দেখলে কোনও বাবা কি চুপ করে থাকতে পারে? |