কিন্তু এখনও ঋতুপর্ণ ঘোষের আকস্মিক মৃত্যু থেকে বেরোতেই পারছে না টলিউড। স্টুডিওয়, প্রযোজকদের অফিসে, ঘরোয়া আড্ডায় তাঁর ছবি, তাঁর জীবনধারা নিয়েই সমানে চলেছে স্মৃতি রোমন্থন।
বৃহস্পতিবার ঋতুপর্ণের বিদায়ের পরেই আর এক আলোচনা ঘুরপাক খেতে শুরু করে টালিগঞ্জে তাঁর শেষ ছবি ‘সত্যান্বেষী’ কে শেষ করবেন?
শ্যুটিং শেষ ঠিকই। কিন্তু সম্পাদনা, আবহসঙ্গীত, ডাবিং, চরিত্রলিপির মতো অনেক কাজই তো বাকি রেখে গিয়েছেন ঋতুপর্ণ।
এই নিয়ে আলোচনা করতেই শুক্রবার সকালে ছবির ঋতুপর্ণর ‘ব্যোমকেশ’ সুজয় ঘোষ হাজির হন ছবির প্রযোজক ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের লেক গার্ডেন্সের অফিসে। তাঁর সঙ্গে আলোচনার পর প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতা জানান, “সুজয় নিজে যেহেতু পরিচালক, তাই তাঁকেই অনেকে মনে করছেন অটোমেটিক চয়েস। তাঁর মতো পরিচালক ছবি শেষ করতে চাইলে তো খুবই ভাল হয়, কিন্তু এখনও কিছুই ঠিক হয়নি। অনেকের সঙ্গেই আলোচনা চলছে। ঋতুদার সঙ্গে যা কথা হয়েছিল, তাতে অগস্ট মাসের ৯ তারিখ ছবি মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। সেটাও বদলাতে পারে।” কিন্তু সুজয় মাঝের এক মাস লন্ডনে থাকবেন। তাই অগস্টে তাঁর পক্ষে ছবির বাকি কাজ শেষ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। সে দিকটাও বিবেচনা করা হচ্ছে।
তা হলে কে শেষ করবেন ‘সত্যান্বেষী’? |
বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে ঋতুপর্ণর ঘনিষ্ঠ তিন বন্ধু ও বহু ছবিতে তাঁর সহকর্মী ক্যামেরাম্যান অভীক মুখোপাধ্যায়, সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র এবং সম্পাদক অর্ঘ্যকমল মিত্রর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রযোজকরা। সুজয় অবশ্য সাফ জানান, তাঁর প্রথম পছন্দ অভীক। “আমি ছবিটা শুরু করেছিলাম অভিনেতা হিসেবে। আজ যদি আমাকে পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়, আমি হয়তো পরিচালক হিসেবে সঠিক সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারব না। যে ছবিতে আমি অভিনয় করছি, সেই ছবিরই পরিচালক হলে আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় খামতি থাকতেই পারে। তাই আমি চাই ছবিটা অভীক মুখোপাধ্যায় শেষ করুক,” জানালেন সুজয়। আর অভীক বলছেন, “ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি শেষ করার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে আমাদের মত, আমরা যারা ঋতুর সঙ্গে বহুদিন কাজ করেছি, ওকে চিনি, ওর সেনসিবিলিটি জানি, তারাই যদি শেষ করি, তা হলেই সব চেয়ে ভাল হয়।’’
ভাবা হয়েছিল আরও দুই পরিচালকের কথা অপর্ণা সেন ও সৃজিত মুখোপাধ্যায়। শ্রীকান্তের কথায়, “অপর্ণা সেনকে আমরা ভেবেছিলাম কারণ এত ভাল চিনত ঋতুদাকে। ঋতুদার অনুভূতিগুলো বুঝতে পারবে রীনাদি। সৃজিতকে নিয়ে এক বারই আলোচনা হয়েছে। কিন্তু জুলাই মাস থেকে যেহেতু সৃজিত নিজেই শ্যুটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, তাই ওর কথা আমরা আর ভাবছি না।”
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে অপর্ণা বলেন, “সত্যান্বেষী আমাকে শেষ করতে দেওয়া হলে দারুণ ব্যাপার হবে। তাতে আমি আমার বন্ধু ঋতুর সঙ্গে আবার রিকানেক্ট করতে পারব। তবে আমার মনে হয়, আমি শেষ করলে ওর ইউনিটের সেটা পছন্দ হবে না।”
সুজয়, অপর্ণা বা অভীক, যে-ই করুন, মোটামুটি জানা গেল, সোম বা মঙ্গলবারের মধ্যেই একটা সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। ‘সত্যান্বেষী’র মুক্তি নিয়েও ভাবনা-চিন্তা সেরে ফেলেছে প্রযোজক সংস্থা। ঋতুপর্ণর সঙ্গে আলোচনার সময় যদিও ঠিক ছিল, ছবি ৯ অগস্ট মুক্তি পাবে, সেই তারিখটাও এক বিশেষ কারণে অদলবদল হচ্ছে। “৯ তারিখের বদলে আমরা ভাবছি ছবিটা ৩০ অগস্ট রিলিজ করব। তার কারণ ৩১ অগস্ট ঋতুদার জন্মদিন। ঋতুদার জন্মদিনে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির তরফ থেকে এটা আমাদের ঋতুদাকে উপহার,” বলছেন প্রযোজক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তি।
শুধু তা-ই নয়, সত্যান্বেষীর বক্স অফিস কালেকশন থেকে ঋতুপর্ণর নামে একটি ট্রাস্ট গঠনের কথাও ভাবা হচ্ছে। যদিও এই চিন্তা একেবারেই প্রাথমিক স্তরে। এর পাশাপাশি ইন্দ্রাণী পার্কের ঋতুপর্ণর বাড়ি ‘তাসের ঘর’কে প্রয়াত পরিচালকের সংগ্রহশালা করা যায় কি না, সেই ভাবনা রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথায়। তবে ঋতুপর্ণর বাড়ির লোকেরা, মূলত তাঁর ভাই ইন্দ্রনীল ঘোষের সঙ্গে আলোচনা করেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে বিশ্বস্ত সূত্রের খবর। ঘনিষ্ঠ মহলে মুখ্যমন্ত্রীও তেমনই বলেছেন।
ঋতুপর্ণর স্মরণসভা নিয়ে আলোচনা করতে আগামিকাল মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস আর্টিস্ট ফোরাম, ফেডারেশন ও পরিচালকদের বৈঠক ডেকেছেন। অরূপবাবু বলেন, “ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো পরিচালকের স্মরণসভা যাতে সেই মাত্রায় হয়, এই নিয়ে আলোচনা করতে রবিবার দুপুর দু’টোয় আমি মিটিং ডেকেছি। এখনও অবধি যা ঠিক হয়েছে, বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে নজরুল মঞ্চেই হবে স্মরণসভা। তারিখটা কালকের বৈঠকের পর জানা যাবে।”
এ ছাড়াও ৭ থেকে ১৩ জুন বিকেলের শোয়ে প্রিয়া সিনেমায় চলবে ঋতুপর্ণর রেট্রোস্পেকটিভ। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ দিয়ে শুরু, শেষ ‘উনিশে এপ্রিল’ দিয়ে। শো শুরুর আগে ঋতুপর্ণর স্মৃতিচারণ করবেন সংশ্লিষ্ট ছবির কলাকুশলীরা।
সব দেখেশুনে একটা জিনিস জলের মতন পরিষ্কার। গত উনিশ বছর ঋতুপর্ণ ঘোষে মজে ছিল টলিউড। তাঁর মৃত্যুর পরেও সেই ধারাই অব্যাহত।
তাঁকে নিয়ে যা হচ্ছে, তা দেখলে ঋতুপর্ণ তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতেই হয়তো বলতেন, “উফফ্, তোরা না পারিসও বটে!”
|