স্কুলের শেষ ধাপ অবধি পড়াশোনা করা যদি একটা লক্ষ্য হয়, তবে সাফল্যের পাল্লা দ্রুত ভারি হচ্ছে মেয়েদের দিকেই। ২০০৯ সালেও মেয়েদের চাইতে ২২ হাজার বেশি ছেলে পরীক্ষা দিয়েছিল। আর ২০১৩ সালে দেখা যাচ্ছে, পরীক্ষা দিচ্ছে ছেলেদের চাইতে ২৮ হাজার বেশি মেয়ে। ২০১২ সালের চাইতে এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মেয়েদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২১ হাজার, ছাত্রের সংখ্যা বেড়েছে মোটে ছ’হাজার।
কিন্তু পাশের হারের দিক থেকে মেয়েরা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে ছেলেদের তুলনায়। বোঝা যাচ্ছে, মেয়েদের মধ্যে পড়াশোনার আগ্রহ বাড়ছে ঠিকই। কিন্তু ফেল করেছে এক লক্ষেরও বেশি ছাত্রী। ছাত্রদের তুলনায় ৯ শতাংশ বিন্দু কম।
স্কুলছুট হওয়াটা অবশ্য রাজ্যের একটা সামগ্রিক সমস্যা। ২০০৪-২০০৫ সালে রাজ্যের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া পড়ুয়ার সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ লক্ষ। অথচ এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে মাত্র ৯ লক্ষ ২০ হাজার পড়ুয়া। মানে প্রায় অর্ধেক ছাত্র-ছাত্রী স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে পড়া শেষ করার আগেই। মানবসম্পদের একটা বিপুল অপচয় ঘটে চলেছে এ রাজ্যে। |
গ্রামে মেয়েদের কাছে স্কুলে যাওয়াটাই একটা স্বাধীনতা। ছবি: অনির্বাণ সেন। |
কেন ব্যর্থ হচ্ছেন বেশির ভাগ মেয়ে? ইনস্টিটিট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, কলকাতা-র অধ্যাপক অচিন চক্রবর্তী বলেন, “দরিদ্র পরিবারে অনেক সময়েই বাড়ির ছেলের লেখাপড়ার পিছনে যতটা খরচ করা হয়, অধিকাংশ সময়েই মেয়েদের ক্ষেত্রে তা হয় না। রাজ্যের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পড়ুয়া প্রাইভেট টিউশন নেয়। কিন্তু তার মধ্যে গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের পরিবারের জন্য কতটা আলাদা করে পরিবারের তরফে যত্ন নেওয়া হয়, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। শুধু স্কুলে পড়লেই হল না, পরিবারের অনেক কাজ করতে হয় মেয়েদের।”
অনুন্নত জেলায় মেয়েদের শিক্ষা শেষ করা আরও কঠিন। সেখানে বেশি মেয়ে পড়া শেষ করার সুযোগ পাচ্ছে না, পাশ করার মতো পড়াশোনাও করতে পারছে না। যেমন পুরুলিয়া। রাজ্যের অন্যান্য জেলায় যেখানে ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক মেয়ে পরীক্ষায় বসেছেন, সেখানে এই জেলায় ছাত্রের তুলনায় ছাত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার কম। পাশের হারও ছেলেদের তুলনায় ১৩ শতাংশ বিন্দু কম। বীরভূমেও ছাত্রের তুলনায় ছাত্রীদের পাশের হার কম ১২ শতাংশ বিন্দু। বীরভূম, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দক্ষিণ দিনাজপুর, পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদে দশে তিন জন মেয়েই অকৃতকার্য হয়েছেন।
তফসিলি জাতি ও উপজাতিভুক্ত পরীক্ষার্থীর মধ্যেও ছাত্রদের তুলনায় প্রায় ২ শতাংশ কম ছাত্রী এ বার পরীক্ষায় বসেছে। অর্থাৎ সামাজিক উন্নয়নের নকশা শিক্ষার নকশাতেও প্রতিফলিত হচ্ছে।
অন্য দিকে, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছাত্রীদের তুলনায় ছাত্রের সংখ্যা প্রতিবারই ক্রমশ কমছে। বোঝা যাচ্ছে, যত সংখ্যক ছাত্র স্কুলে ভর্তি হচ্ছে, মাধ্যমিক দিচ্ছে তার চেয়ে অনেক কম। ছাত্রীদের মধ্যে স্কুলে টিকে যাবার প্রবণতা দেখা গেলেও, ছাত্রদের মধ্যে সেই ধারা দেখা যাচ্ছে না। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, ছাত্রদের মধ্যে স্কুলছুট বাড়ছে কিনা। অচিনবাবু বলেন, “এই ধারাটা বেশ কিছু দিন ধরেই আমরা লক্ষ্য করেছি। আসলে গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের কাছে স্কুলে যাওয়াটাই একটা স্বাধীনতা। ছেলেদের কাছে তা নয়। তারা স্কুলের বাইরে অন্যত্র স্বাধীনতা খুঁজে নিচ্ছে। ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে স্বাধীনতার অর্থের তারতম্য মাধ্যমিকে-বসা ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যার মধ্যে অনেকটা তফাত তৈরি করে দিচ্ছে।” |