পঞ্চায়েত ভোটে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে শেষ পর্যন্ত ৪০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে দিল্লির দ্বারস্থ হল রাজ্য। কিন্তু এমন একটা সময়ে রাজ্য এই সিদ্ধান্ত নিল, যখন কেন্দ্রের পক্ষে এত বাহিনী পাঠানো কতটা সম্ভব, তা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদী হামলার ঘটনার পরে। তাই নির্বাচন কমিশনের চাহিদা মতো নিরাপত্তা বাহিনী পঞ্চায়েত নির্বাচনে অদৌ মিলবে কি না, সেই আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এর ফলে পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটল না মঙ্গলবারও। এর মধ্যেই আজ, বুধবার থেকে প্রথম দফার ভোটের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে যাচ্ছে।
মহাকরণ সূত্রের খবর, তাঁরা যে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইছেন, তা জানিয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সচিবের কাছে চিঠি দিয়েছেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব। তবে সন্ধ্যায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে তাঁর দফতর ছাড়ার আগে পর্যন্ত সেই চিঠি নির্বাচন কমিশনের দফতরে পৌঁছয়নি। কমিশনের একটি সূত্র এ দিন জানান, পঞ্চায়েত ভোটে ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার জন্য গত বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে রাজ্যকে চিঠি দিয়ে আসছে তারা। রাজ্য তখন গা করেনি। এখন শেষ মুহূর্তে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে দিল্লিকে চিঠি পাঠানোর কোনও অর্থই হয় না। কারণ, এত তাড়াতাড়ি যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বাহিনী পাঠাতে পারবে না, তা রাজ্য বিলক্ষণ জানে।
কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে শেষ মুহূর্তে রাজ্য সরকারের এই মত বদল কেন? মহাকরণ সূত্রের খবর, পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রস্তুতি কেমন হচ্ছে, তা জানতে এ দিন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে বাহিনী নিয়ে সমস্যার কথা ওঠে। রাজ্যপাল বৈঠকে বলেন, “আমি আপনাদের কাছে প্রস্তুতির খোঁজখবর করছি। শান্তিতেই ভোট হবে বলে আমার আশা। কিন্তু বাহিনীর সমস্যা মিটবে কী করে?” প্রশাসনের কর্তারা রাজ্যপালকে বলেন, “ভিন রাজ্য থেকে পুলিশ এনে সামাল দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। প্রয়োজনে কেন্দ্রের সাহায্যও নেওয়া হতে পারে।” রাজভবন থেকে ফেরার পর মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্রশাসনিক কর্তারা। সেখানে তাঁরা জানান, ভিন রাজ্য থেকে পুলিশ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এমন অবস্থায় কমিশন আদালতে চলে গেলে রাজ্য বিপদে পড়বে। আদালতে রাজ্য সরকারই হলফনামা নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ নিরাপত্তা বাহিনী দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। এখন তা দিতে না পারলে সরকারের মুখ পুড়বে। তার চেয়ে বরং কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়াই যুক্তিসঙ্গত। বৈঠকে অনেকে এ-ও বলেন, কেন্দ্র নিরাপত্তা বাহিনী দিতে না পারলে তার দায় রাজ্যের ঘাড়ে পড়বে না। তখন উল্টে বিষয়টি নিয়ে তারা সরব হতে পারবে। প্রশাসনিক কর্তাদের এই যুক্তি মেনে নেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরই দিল্লির কাছে নিরাপত্তা বাহিনী চাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়। মহাকরণের সূত্রটি জানিয়েছেন, রাজ্য ৪০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইছে। ওই বাহিনী পেলেই নিরাপত্তার ঘেরাটোপে পঞ্চায়েত ভোট করা সম্ভব বলে রাজ্য সরকার মনে করে। নির্বাচন কমিশনকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েও দিয়েছে রাজ্য সরকার। রাজ্যপালকেও তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মহাকরণ সূত্রের খবর।
কিন্তু সত্যিই কি পঞ্চায়েত ভোটে নিরাপত্তা বাহিনী সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান আর সম্ভব? সরকারেরই এক শীর্ষ মন্ত্রী এ দিন বলেন, “এখন যা পরিস্থিতি, তাতে কেন্দ্র ফোর্স পাঠাবে বলে মনে হয় না। ফলে নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা করা যাবে না। আর না হলে ভোটই বা হবে কী করে?” নির্বাচন কমিশনের একটি সূত্রও এ দিন একই প্রশ্ন তুলেছেন। আর দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি সূত্রের বক্তব্য, এ বছর মার্চ-এপ্রিলে যখন নিরাপত্তা বাহিনীর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছিল, তখন যদি রাজ্য বাহিনী চেয়ে রাখত, সমস্যা হত না। কেন্দ্রের তরফে এই ইঙ্গিত সে সময় দেওয়াও হয়েছিল। কিন্তু এখন কী হবে, তা নিশ্চিত করে বলতে নারাজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ওই সূত্রটি।
মনোনয়ন পর্ব থেকেই কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য রাজ্যকে আগাগোড়া বলেছে নির্বাচন কমিশন। সে জন্য অন্তত ৩০ হাজার নিরাপত্তা বাহিনী চেয়েছিল তারা। মনোনয়ন দিতে যাওয়ার রাস্তাতেও পুলিশি টহলদারির নির্দেশ দিয়েছিল কমিশন। কিন্তু প্রথম দফার ২১০টি ব্লকে রাজ্য এখনও পর্যন্ত মাত্র ৩৫০০ পুলিশ মোতায়েন করতে পারবে বলে জানা গিয়েছে! আজ বুধবার থেকেই মনোনয়ন পর্ব শুরু হচ্ছে। আগামী সাত দিন নির্বিঘ্নে মনোনয়ন পর্ব শেষ করাটা রাজ্য পুলিশের কাছে এখন অগ্নিপরীক্ষা বলে মনে করা হচ্ছে।
এ দিন মহাকরণে রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) বাণীব্রত বসু বলেন, “আজ, বুধবার থেকেই বিডিও ও এসডিও অফিসে পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হবে। পুলিশ টহল দেবে বিভিন্ন এলাকায়। সব জায়গায় পুলিশ দেওয়া সম্ভব নয়। যেখানে পুলিশের প্রয়োজন রয়েছে সেখানে পুলিশি নিরাপত্তা থাকবে। জেলা পুলিশ সুপার ও জেলা শাসকদের সঙ্গে আলোচনা করেই এই ব্যবস্থা হয়েছে।” বাণীব্রতবাবু জানান, ছত্তীসগঢ়ের ঘটনায় রাজ্য সতর্ক হয়েছে। জঙ্গলমহলে ৩৯ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী রয়েছে। জঙ্গলমহলে প্রচারের আগে পুলিশকে সব জানাতে বলা হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলিকে।
বুধবার থেকে শুরু হওয়া মনোনয়ন পর্বে প্রার্থীদের হলফনামা দিয়ে সম্পত্তির হিসেব দেওয়ার যে নির্দেশ কমিশন জারি করেছিল, তা শিথিল করা হয়েছে। এ নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে বলেন, ত্রিস্তরেই ঘোষণাপত্র দিতে হবে। সাদা কাগজে দিলেও হবে। কমিশন জানিয়েছে, বুধবার প্রথম দফার ভোটে বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৩টে পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া পারবেন প্রার্থীরা।
|