তফসিলি জাতি ও উপজাতি প্রভাবিত একটি অনুন্নত এলাকার ছাত্রছাত্রীকে উচ্চশিক্ষার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার ব্রত পালন করছেন এক দল শিক্ষকশিক্ষিকা।
বছর দুয়েকের ওই প্রচেষ্টায় ফলও মিলেছে। পিছিয়ে থাকা স্কুলটির নাম কোদলা বিজয়কৃষ্ণ আদর্শ বিদ্যামন্দির। স্কুলের ৫২ জন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৫১ জনই সফল। তাদের মধ্যে রয়েছে হতদরিদ্র রাজমিস্ত্রির ছেলে হারাধন পাল, যে শতকরা ৮৩ ভাগ নম্বর পেয়েছে। গত বছর ওই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল মোট ৫৫ জন। তার মধ্যে পাশ করেছিল ৫২ জন। ওই ৫২ জনের মধ্যে ছিল শতকরা ৮৫ ভাগ নম্বর পাওয়া বিপিএল পরিবারের মেয়ে শিল্পা মণ্ডল।
এলাকার অর্থনীতি গো-পালন, কৃষিকাজ ও দিনমজুরির উপর নির্ভরশীল। তপসিলি জাতি অধ্যুষিত ওই এলাকার ছাত্রছাত্রীদের উচ্চমাধ্যমিকের দোরগোড়ায় পৌঁছনোর আসল কৃতিত্ব কিন্তু ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক-সহ ১৮ জন শিক্ষকশিক্ষিকা আর দু’ জন অশিক্ষক কর্মীর।
টেস্ট পরীক্ষার দু’ দিন পর থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরুর দু’দিন আগে পর্যন্ত মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের চলতে হয় তাদের স্কুল থেকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া ২৪ ঘণ্টার সময় সারণি মেনে। যার মধ্যে রয়েছে ঘুম থেকে ওঠা, খাওয়া, অবসর, টিউশন নেওয়া, কোচিং, বাড়িতে পড়া-সহ ভোর ৫টা থেকে রাত ১১টার নির্ঘণ্ট। স্থানীয় জমিদারদের দান করা সাড়ে পাঁচ বিঘা জমির উপর ওই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত প্রায় চার দশক আগে। সরকারি অনুমোদন মেলে ১৯৭৯ সালে। বর্তমানে দোতলা ভবন। জুনিয়র হাইস্কুলটি ২০০৯ সালে মাধ্যমিকে উন্নীত হয়। তারপর থেকে শুরু হয় মাধ্যমিক পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীরা কি ভাবে ভাল রেজাল্ট করে পারে সেই বিষয়ে ভাবনাচিন্তা। |
প্রধান শিক্ষক সুভাষ সিমলান্দী বলেন, “শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনা করার পর ঠিক হয় টিফিনের সময় ছাত্রছাত্রীরা তাদের সমস্যাগুলি বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক শিক্ষিকাদের কাছে গিয়ে সমাধান করে নেবে। সেই মতো ক্লাসে নোটিশও দেওয়া হয়। শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির করা হয়, বই ব্যবসায়ীদের থেকে বিনামূল্যে পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত কার্যকরও হয়। ওই সব বই থেকে ছাত্রছাত্রীদের ‘হোমওয়ার্ক’ দেওয়া হয়। সেগুলি ঠিক মতো করেছে কিনা সপ্তাহান্তে শিক্ষকশিক্ষাকারা দেখে নেন।” মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষার দু’ দিন পর থেকে স্কুলের মধ্যে শুরু করা হয় ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত বিষয় ভিত্তিক বিনা পয়সার কোচিং ক্লাস। সেই ক্লাসের জন্য পরীক্ষার্থীদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে নেওয়া হয়।
এ বারের ৫২ জন পরীক্ষার্থীকে ৩টি দলে ভাগ করা হয়। যারা শতকরা ৬০ ভগের বেশি নন্বর তুলতে পারবে তাদের একটি দল, যারা পাশ করতে পারবে এমন পরীক্ষার্থীদের একটি দল। যারা পাশ করার মতো নয় তাদের আর একটি দল। ক্লাসে গড়পড়তা পড়ানো হয়। তাতে মেধাবীদের যেমন চাহিদা মেটে না। আর নিম্মমেধার পরীক্ষার্থীদেরও পক্ষে হজম করা কঠিন হয়ে ওঠে। এ কারণে ওই বিভাজন।
দল বিভাজন, কোচিং ক্লাস ও সময় সারণীর সুফলও মিলেছে। হতদরিদ্র হারাধন পাল শতকরা ৮৩ ভাগ নম্বর পেয়েছে। ফের টেস্ট পরীক্ষায় অংকে ২ নম্বর পাওয়া গঙ্গা হালদার ২৫ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল। লেখাপড়া ছাড়াও ওই স্কুলের শিক্ষকরা পড়ুয়াদের স্বাস্থ্যের প্রতিও যত্নশীল। এ বারের কৃতী ছাত্র হারাধন বলে, “আমাদের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছেন শিক্ষকরা। স্কুলের কম্পিউটরে ব্রড ব্যান্ড কানেকশনও নেওয়া হয়েছে।” গত বছর পড়ে গিয়ে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর হাতের হাড় ভেঙে যায়। হতদরিদ্র ছাত্রীটির চিকিত্সা করাতে খরচ হয় ১১০০ টাকায় ওই টাকা জোটাতে ওই পরিবারের হাড়ি কলসি বন্ধক দিতে হয়। হারাধন বলে, “ওই কথা জানতে পেরে শিক্ষকরা ১১০০ টাকা দিয়ে বন্ধক রাখা হাড়ি কলসি ছাড়িয়ে দেন।”
এত সব করেন কেন? প্রধান শিক্ষক বলেন, “শিক্ষক শিক্ষিকা ও অশিক্ষক কর্মী মিলে আমরা মোট ২০ জন রয়েছি। আমরা সবাই ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের পরিবারের সদস্য মনে করি। তা না করলে পিছিয়ে থাকা ওই এলাকার পিছিয়ে পড়া তফশিলি জাতি উপজাতির ছেলেমেয়েদের উন্নতি হবে না যে!” |