দৃশ্য ১। সদ্য ভোরের আলো ফুটেছে। ‘নাইট ডিউটি’তে ক্লান্ত দৌলতপুর সীমান্তের রক্ষীদের চোখও বুজে এসেছে। দূরে নজরে এল বিড়ির পাতা বোঝাই ঝুড়ি নিয়ে চলেছে দুই যুবক। এলাকায় বিড়ি শিল্পের রমরমা। তাই সন্দেহের তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু ওই দুই যুবকের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় হাঁক পাড়লেন এক জওয়ানকেয়া হ্যায় রে টুকড়ি পে? চিৎকার শুনেই পগাড়পাড় যুবকেরা। ঝুড়ি হাতড়াতেই মিলল দু’টি আমেরিকান পিস্তল ও ম্যাগাজিন ভর্তি গুলি।
দৃশ্য ২। মাঝবয়সী এক মহিলার আটপৌড়ে শাড়ির আঁচলে বাঁধা মুড়ি। তখন সন্ধ্যে। স্বাভাবিক ছন্দেই পদ্মার হাঁটুজল পেরিয়ে তিনি চলেছেন শোভাপুরের পথে। কেন যেন সন্দেহ উঁকি মারল কতর্ব্যরত জওয়ানের মনে। মহিলাকে থামাতেই আঁচলের মুড়ির বাঁধন আলগা করতেই বেরিয়ে এলো ১২ হাজার টাকার একগোছা জাল নোট। মহিলার আকুতিতে সীমান্ত রক্ষীরা ছেড়ে দেন তাঁকে। কেন, সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
দৃশ্য ৩। এলাকায় ফুটবল খেলার তেমন একটা চল নেই। তবুও বছর চোদ্দোর এক কিশোর প্যাকেট বন্দি একটি ফুটবল নিয়ে হেঁটে চলেছে সীমান্ত বরাবর। প্রথমে ভালোই লেগেছিল বিএসএফ জওয়ানের। যতই হোক, অজ পাড়া গাঁয়েও তাহলে এ বার ফুটবল চালু হতে চলেছে। কিন্তু একই সঙ্গে সন্দেহও হয়েছিল। হাজার হোক সীমান্ত এলাকা বলে কথা। বলটা চাইলেন জওয়ান। ফুটবল ফেলে প্রাণ ভয়ে ছুট লাগাল ওই কিশোর। বেয়নটের খোচায় বলটি কাটতেই চক্ষু চড়কগাছ বিএসএফের। বলের ভিতর থেকে উদ্ধার হল ১ লক্ষ ৭৮ হাজার টাকার জাল নোট।
দৃশ্য ৪। শোভাপুর চর বেয়ে চলে গেছে উঁচু তার কাঁটার বেড়া। বন্ধ গেটে তখন রাত বড় জোর ৮টা। হঠাৎই আলোর ঝলকানিতে চোখে পড়ল বাংলাদেশের দিক থেকে বেড়া টপকে একটি গামছার পুঁটলি কেউ যেন ছুড়ে দিল ভারতের দিকে। জওয়ানরা দৌড়ে গিয়ে পুঁটলি খুলতেই হতবাক। তিনটি পিস্তল ও ৪ রাউন্ড গুলি তার মধ্যে। |
মালদহের দৌলতপুর, শোভাপুর থেকে লালগোলার খান্ডুয়া পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিলোমিটার সীমান্ত পথে এখন এ ভাবেই পাল্টেছে চোরাকারবারের খন্ডচিত্র। বিশাল পদ্মাজুড়ে শুধুই ধূ ধূ বালুকারাশি। কোথাও হাঁটু জল আবার কোথাও তার চেয়ে সামান্য একটু বেশি। নদীপথের প্রায় ৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া নেই। এক দিকে চর, অন্য দিকে বাংলাদেশের শিবগঞ্জ, চাপাই নবাবগঞ্জের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল। ভারতের সীমান্ত আগলাচ্ছেন ২০, ১৪৩, ১২৫ ও ৩১ নম্বর ব্যাটেলিয়নের জওয়ানরা। বাংলাদেশের ৯ ও ৪৩ নম্বর ব্যাটেলিয়নের জওয়ানরা সে দেশের সীমান্ত পাহারা দিচ্ছেন। বিএসএফ-বিজিবি-র এই নজরদারিকে উপেক্ষা করেই চলছে চোরাচালান। ২০১২ সালে বিএসএফ ধরেছে ৯ হাজার গরু। আটক করা হয়েছে ৩০০ পাচারকারী। গত ৫ বছরে সীমান্তে ২.৫ কোটি টাকার জাল নোট উদ্ধার হয়েছে। বাংলাদেশে ঢুকছে কাশির সিরাপ। বিজিবি-র ৯ নম্বর ব্যাটেলিয়নের কমান্ড্যান্ট মঞ্জুর আলমের কথায়, হু হু করে এই সিরাপ ঢুকছে। যুব সম্প্রদায় এই সিরাপের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকছে। গত বছরেই আটক করা হয়েছে কয়েক লক্ষ বোতল সিরাপ। তবুও থামানো যাচ্ছে না এই পাচার।
গত বছর এই সীমান্তেই পুলিশ ৭৮ লক্ষ টাকার জাল নোট উদ্ধার করে। আর বিএসএফ জওয়ানরা আটক করে ৬০ লক্ষ টাকার উপরে। বিএসএফের কমান্ড্যান্ট অরবিন্দ ঘিরডিয়াল বলেন, “সীমান্তবাসীদের দারিদ্রের সুযোগ নিচ্ছে পাচারকারীরা। প্রান্তিক মানুষকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পাচারের কাজে। নদীতে জল থাকলে সীমান্ত পাহারা দেওয়া সহজ হয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই পদ্মায় জল থাকে না। পায়ে হেঁটে পাহারা দিতে সীমান্ত। জওয়ানের ঘাটতি রয়েছে। তবে লাঠি হাতে স্থানীয় তরুণদের সীমান্ত পাহারায় নিয়োগ ও বিজিবি-র সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে পাচারের তীব্রতা কমানোর চেষ্টা চলছে। অনেকটা সফলতাও মিলেছে।” তাছাড়া সীমান্ত আগলানোর সবচেয়ে বড় সমস্যা সড়ক পথের অভাব। আলো নেই, জল নেই, যানবাহন নেই। অরবিন্দবাবু বলেন, “বাংলাদেশের সীমান্তের গ্রামগুলিতে রাস্তা-ঘাট, জল ও আলোর ব্যবস্থা হয়েছে। আর এ পারে ছিটেফোঁটা উন্নয়নটুকুও হয়নি। অন্ধকারে সীমান্ত পাহারায় ভরসা কেবল টর্চ লাইট।” ডিআইজি অমরজিৎ সিংহের কথায়, “সীমান্ত পাহারায় দরকারি উপকরণের অভাব রয়েছে।”
পাচারের নয়া কৌশল ঠেকাতে গত ২২ মে দু’দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে বসে। বাংলাদেশের তরফে কাশির সিরাপ পাচার ও ভারতের পক্ষে জাল নোট ঢোকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। দু’দেশের সাধারণ মানুষকে পাচারকারীরা ‘বাহক’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই অনেক সময় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীরা তাঁদের প্রতি কঠোর হতে পারেন না।
|