নূতন সরকারের দুই বছরের শাসনে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যচিত্রে যদি কোনও ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটিয়া থাকে, তাহা এখনও ‘গোপন তথ্য’। সরকারি হাসপাতালগুলির চিকিৎসা-পরিষেবা কতটা বিপর্যস্ত, তাহার সর্বশেষ উন্মোচনটি আসিয়াছে এক সরকারি হাসপাতালেরই সুপারের লেখা অভিযোগপত্রে, যাহাতে তিনি কলিকাতা মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে স্ত্রীরোগের চিকিৎসার জন্য পাঠানো তাঁহার এক নিকটাত্মীয়ার চিকিৎসায় চরম গাফিলতির নজিরগুলি নথিভুক্ত করিয়াছেন। রোগিণীকে যে শেষ পর্যন্ত জরুরি অস্ত্রোপচার করাইতে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাইতে হয়, তাহার উল্লেখ করিয়া সুপারের প্রশ্ন: একটি হাসপাতালের শীর্ষপদে আসীন হইয়াও এবং নিজের যাবতীয় পরিচিতি ব্যবহার করিয়াও তিনি যদি নিকটাত্মীয়ার সুচিকিৎসা সরকারি হাসপাতালে নিশ্চিত করিতে না পারেন, তবে সাধারণ চিকিৎসাপ্রার্থীদের না-জানি কী দুরবস্থায় পড়িতে হয়!
দুরবস্থার কথা ভুক্তভোগী জনসাধারণ জানেন। একে তো রোগী ভর্তি করানোই এক বিষম ব্যাপার। দালাল-চক্রকে অতিক্রম করিতে না পারিয়া তাহাকে ‘খুশি’ করিয়াই রোগীর আত্মীয়দের অগ্রসর হইতে হয়। তাহার উপর রোগীর দেখভাল করিবার ব্যবস্থাটি অপটু, চিকিৎসার বিলম্ব, ঔষধ নির্মাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য, ওয়ার্ড-বয়, আয়া ও নার্সদের উদাসীন এবং ক্ষেত্রবিশেষে অমানবিক আচরণ এই সব অভিযোগই সরকারি হাসপাতালে অব্যাহত। হাসপাতালগুলির হাল ফিরাইবার এবং পরিকাঠামোর উন্নয়ন ও পরিষেবার উন্নতি ঘটাইবার যে-প্রতিশ্রুতি নূতন সরকারের কর্ণধারদের মুখে একদা শুনা গিয়াছিল, সে সবের কিছুই পূরণ হয় নাই। বরং দলতন্ত্র আরও জাঁকিয়া বসিয়াছে, অনুগত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পুরস্কৃত করা এবং দক্ষ, বিবেকবান অথচ স্বাধীনচেতা চিকিৎসকদের গুরুত্বহীন পদে বদলি করিয়া কোনও দায়িত্ব না-দিয়া বসাইয়া রাখার প্রতিহিংসামূলক শাসননীতি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে, এমন কথা মনে করিবার কারণ আছে। শিক্ষার মতোই, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও কৃতীরা হয় রাজ্য ছাড়িতেছেন, নয়তো সরকারি পরিষেবা হইতে নিজেদের বিযুক্ত করিতেছেন।
ইহারই মধ্যে অনুগত কিংবা দলীয় সমর্থক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘বঙ্গ চিকিৎসা সম্মান’ নামক এক পঁচিশ-হাজারি পুরস্কার দিবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প ‘গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন’-এর তহবিল খরচ করিবার সিদ্ধান্ত হইয়াছে। যে প্রকল্পের উদ্দেশ্য সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শিশুজন্মের হার বাড়ানো, তাহার তহবিল দিয়া বশংবদ চিকিৎসকদের পুরস্কৃত করার এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত আপত্তিকর। এই ধরনের অপব্যবহারের নেট ফল কিন্তু সংশ্লিষ্ট পরিষেবাগুলির মানের অবনতি। শিক্ষায় যেমন, স্বাস্থ্যতেও তেমনই গুণগত উৎকর্ষের অবনমন এখনও এ রাজ্যের বৈশিষ্ট্য। এই ঐতিহ্য দুই বছরে বদলায় নাই। দুই বছর কম সময় নহে। |