ছোট পরিবার! সুখী পরিবার!
দক্ষিণ কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে আইপিএল ফাইনাল প্রাক্কালে আয়োজিত শনিবারের নৈশভোজে ভারতীয় ক্রিকেট পরিবারের মেজাজ ছিল ঠিক তাই। জগমোহন ডালমিয়ার দেওয়া সেই নৈশভোজে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজীব শুক্ল, ডালমিয়া নিজে, পঞ্জাবের ওয়ালিয়া, বোর্ড সচিব জাগদালে এবং অবশ্যই নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন। রাত্তির দশটা নাগাদ নৈশভোজে থাকা এক বোর্ড সদস্য জানালেন, সাহেবের মেজাজ খুব ভাল। নিজের ভালবাসার ব্র্যান্ডটাই খাচ্ছেন। ব্লু লেবেল। এ-ও জানা গেল, শ্রীনিবাসনকে ঘিরে হাসিমুখে অনুগত সব বোর্ড সদস্য। সাহেবও তাই খোশমেজাজে। অল ইজ ওয়েল। মনে করছেন সর্বনাশা নিম্নচাপ কেটে গিয়েছে।
বোর্ডের একত্রিশ সদস্যের সুখী পরিবারের সতেরো জন সেখানে হাজির। আর তাঁদের নৈশভোজ বর্ণনা শুনতে শুনতে ইডেনে শুক্রবার রাতে শোনা সেই প্রাক্তন ক্রিকেটারের ভবিষ্যদ্বাণী মনে পড়ে যাচ্ছিল। “সিএসকে যেমন ম্যাচে দেরিতে ফেরে কিন্তু ম্যাচটা জিতে শেষ করে, এখানেও তা-ই হবে।” শ্রীনিবাসন কি তা হলে ধোনির সিএসকে হয়ে গেলেন? এ দিন দুপুরেও যাঁরা তাঁকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়ার এত সব স্ট্র্যাটেজি করছিলেন, তাঁরাই কি না সাক্ষাতে নেতিয়ে রইলেন। তার চেয়েও আশ্চর্যের, শ্রীনিবাসনের বিরুদ্ধে ওঠা অসূয়ার যিনি সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মুখ, সেই অরুণ জেটলি কি না রাতে কলকাতায় এলেনই না। যখনই তিনি পৌঁছন, শ্রীনিবাসন তার আগে নিজের রক্ষণ আরও মজবুত করে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। রাতে চিড়িয়াখানার কাছে কংগ্রেসের কোনও একটা শাখা আইপিএল কেলেঙ্কারি নিয়ে সেই নৈশভোজের বাইরে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। তাতে পার্টির মেজাজের ওপর ন্যূনতম ছাপ পড়েনি।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে বলা হয় ভাগ্যের বরপুত্র। কোথাও এসে ধোনির ত্রাণকর্তা এবং তাঁর ভাগ্য কি একই সঙ্গে মিলে গেল? ধোনির যেমন প্রচুর ক্রিকেট শত্রু। কিন্তু কেউ তাঁকে ঠিক বধ্যভূমিতে নিয়ে যেতে পারছেন না। শ্রীনিবাসনও যেন তেমন। ফ্র্যাঞ্চাইজিরা এ দিনও তাঁর বিরুদ্ধে উত্তেজিত অভিযোগ করেছে। বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় কর্তারা তাঁর বিরুদ্ধে। পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী ললিত মোদী বা এসি মুথাইয়া তাঁর পদত্যাগের তীব্র দাবি তুলেছেন। এগুলো তো তবু জলভাত। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস মন্ত্রীরাও যে এ দিন তাঁকে সরে যেতে বলেছেন। লালুপ্রসাদ যাদব বলেছেন। ওমর আবদুল্লা বলেছেন। এ রকম বিবিধ। তবু শনিবার রাত পর্যন্ত শ্রীনিবাসনই ভারতীয় ক্রিকেটের শুধু অবিসংবাদী সিংহাসনে থেকে গেলেন না, আইপিএল চ্যাম্পিয়নের ট্রফিটাও মাঠে তিনিই তুলে দেবেন। ভিন্ রাজ্যের এক ক্রিকেট কর্তা যা শুনে বললেন, “আশা করব ইডেনের মানুষ অন্তত ওকে ঠিক ভাবে বরণ করবে।” |
আসলে ভারতীয় ক্রিকেট কর্তাদের হাল এটাই। বেড়ালের গলায় নিজেরা ঘণ্টা বাঁধতে না পেরে তাঁরা এখন ইডেনের দর্শকের ঘাড়ে বন্দুক রাখতেও তৈরি। গুরুনাথকে মুম্বই পুলিশ গ্রেফতার করাটা যদি শ্রীনিবাসন ম্যাচের পাওয়ার প্লে হয়, যেন ৭ থেকে ১৪ ওভার ছিল আজ। আর তাতে ভয়ঙ্কর চাপে থাকা বোর্ড প্রধান অবিশ্বাস্য কামব্যাক করলেন! ক্রিকেট কর্তারা এ ওকে ঠেলাঠেলি করলেন যে, আপনি গিয়ে বলুন না ক্রিকেটের স্বার্থে শ্রীনি-র সরে যাওয়াই উচিত। অথচ কেউ সাহস করে নিজের মুখে বলতে পারলেন না। দুপুরে আইপিএল চেয়ারম্যান রাজীব শুক্ল যান জগমোহন ডালমিয়ার বাড়ি। কাছাকাছি সময়ে শ্রীনিবাসন মুম্বই বিমানবন্দরে জড়ো হওয়া সমবেত টিভি চ্যানেলকে জানিয়ে দিয়েছেন, কোনও মতেই ইস্তফা দেবেন না। যেহেতু তিনি কোনও অন্যায় করেননি। এমন আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষা দেখার পরেও শুক্ল-ডালমিয়া বৈঠক ঘিরে জাতীয় ক্রিকেটমহল উদ্বেলিত ছিল। তাদের ধারণা ছিল, এ-ই আলিপুর মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয়ে গেল। ইস্তফাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
তাঁরা যদি জানতেন, ওই বৈঠকেই বরঞ্চ সিদ্ধান্ত হয় আরও সাবধানী হওয়ার। আরও ধীরে খেলার। চব্বিশ ঘণ্টা আগেও শ্রীনিবাসন হঠাও অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন শরদ পওয়ার এবং অরুণ জেটলি। পওয়ারের এখন বোর্ডের বৈঠকে আসার প্রশ্ন নেই। কিন্তু আত্মীয়ের বিয়ে আছে, এই অজুহাতে জেটলির ডিনারে না আসাটা অনেকেরই অস্বাভাবিক লাগে। বিশেষ করে এই সময় যখন প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি ঘণ্টায় পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। প্রাক্তন বোর্ড প্রেসিডেন্ট শশাঙ্ক মনোহর হঠাৎ কলকাতায় উদয় হতে পারেন, এমন আশাও শ্রীনি-বিরোধীদের মনে ছিল। গতকাল সন্ধে পর্যন্ত মনোহর বিদ্রোহের সঙ্গীই ছিলেন। দেখা গেল তিনিও গরহাজির। আসলে শ্রীনিবাসন-বিরোধী জোট বুঝে নেয়, স্বাভাবিক বোর্ডের আইনের রাস্তায় চললে তাঁকে হারানো প্রায় অসম্ভব। বোর্ডকে এমনই একনায়কতন্ত্রে রূপান্তরিত করে ফেলেছেন তিনি। যাবতীয় চাপের মধ্যেও নম্বর তাঁর দিকে। সাদা বাংলায় যাকে বলা হয় ভোটসংখ্যা।
বোর্ডের সংবিধান অনুযায়ী এই রকম পরিস্থিতিতে বোর্ড প্রধান যদি নিজে চাপের কাছে নতিস্বীকার করে চলে যান, তা হলে কোনও সমস্যা নেই। দ্রুত তাঁর জায়গায় কমিটি যাকে মনে করবে তাকে প্রেসিডেন্ট করতে পারে। সমস্যা হল যখন শ্রীনিবাসনের মতো প্রধান যেতে সম্মত নন, তখন।
তখন পরপর পদ্ধতি হল: অন্তত দশ জন সদস্য লিখিত ভাবে সচিবকে আবেদন জানাবেন সংশোধনী বৈঠক ডাকার। সেই বৈঠকে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি গড়া হবে। এঁরাই প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখবেন। তৃতীয় ও শেষ ধাপ হল বিশেষ সাধারণ সভা ডেকে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির সুপারিশ সদস্যদের সামনে পেশ করা। এর পর প্রেসিডেন্টকে বহিষ্কার করতে হলে ওই সভায় তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা দরকার। মানে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট ভারতীয় বোর্ডের প্রধান পদ থেকে শ্রীনিবাসনকে বহিষ্কারের জন্য অন্তত ২৩ ভোট দরকার।
এই জায়গাটাতেই শ্রীনি-বিরোধীরা সাময়িক থমকে গিয়েছেন। জনমত যে পর্যায়ে তাঁর বিরুদ্ধে পৌঁছেছে, তাতে সেই চাপ সামলে সিএসকে কর্তা যে এত আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষা দেখাবেন, কেউ ভাবেনি। এ যাত্রা তাঁরা না হয় কুড়িয়ে-বাড়িয়ে দশ আবেদনকারী জোগাড় করে একটা সভা ডাকানোর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু ২৩ ভোট আনবে কে? এই ক’বছরে বোর্ড নিজের মতো এমন গুছিয়ে নিয়েছেন শ্রীনি। যে ভাবে অকাতরে দাক্ষিণ্য বিলিয়েছেন তাঁর ভোটারদের, তাতে এরা তাঁর পাক্কা গুণমুগ্ধ হয়ে গিয়েছে। বিন্দ্রা + পওয়ার + ডালমিয়া + জেটলি + শুক্ল + যাদব + মনোহর মিলে যতই হোক, তেইশ তো আর হবে না। তখন দাঁড়িয়ে হারতে হবে। কে নেবে সেই ঝুঁকি?
দেশের ক্রিকেটাররাও যেমন কোনও ঝুঁকি নিচ্ছেন না। বিষেণ বেদী বাদ দিয়ে দেশের নামী ক্রিকেটসমাজ নিশ্চুপ হয়ে বসে রয়েছে। গাওস্কর, কপিল, সিধু কেউ মুখ খুলছেন না। অফিশিয়াল সেট ম্যাক্স চ্যানেলে এখনও অকাতরে চলছে জাম্পিং ঝপাং। এই পরিস্থিতিতে শ্রীনিবাসন-বিরোধী জোট কিছুটা নিশ্চুপ। এ দিন প্রচুর ডট বল খেলল। শশাঙ্ক নাকি ঘনিষ্ঠমহলে বলেছেন, সবাই বললে অন্তর্বর্তিকালীন নেতা হতে তাঁর কোনও আপত্তি নেই। তা বলে সেটা হওয়ার জন্য তিনি কোনও বিদ্রোহে সামিল হচ্ছেন না। অর্থাৎ যতই প্ররোচনা থাক, হেলিকপ্টার শট মারবেন না।
ভারতীয় ক্রিকেটের বৃহত্তম কেলেঙ্কারিতে এমন চরম নিমজ্জিত থাকার পরেও তাই শ্রীনিবাসনের উইকেট ফেলা যাচ্ছে না। সিএসকে-ও দিব্যি ফাইনাল খেলে ফেলছে। দিনভর ভারতীয় ক্রিকেটমহলে কথা বলে যা নির্যাস পাওয়া গেল, বোর্ড প্রধানকে টাইট করার জন্য অন্তিম তিনটে রাস্তা।
• ট্রফি হাতে তুলে দেওয়ার সময় ইডেন তীব্র ধিক্কার দিল। তখন লজ্জিত শ্রীনিকে বলা সম্ভব, ভারতীয় ক্রিকেট এত বড় কলঙ্কে পড়েছে যে আপনি সাময়িক সরে গিয়ে ভাবমূর্তিটার উন্নতি করতে দিন।
• ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকার থেকে সরাসরি চাপ এল। একক মন্ত্রী নয়, সরাসরি সরকারের চাপ।
• স্পট-ফিক্সিং মহাবিতর্কে একেবারে ফ্যালফ্যাল করে দেওয়া নতুন কিছু তথ্য হাতে উঠে এল। যাতে শ্রীনিবাসন আরও লজ্জায় পড়লেন।
এ দিন বিকেলে কোদাইকানাল থেকে এসি মুথাইয়া বলছিলেন, “এটা কী ধরনের বিচার? যে তুমিই বিচারক, তুমিই অপরাধী।” একই কথা অনেকের গলায়। কিন্তু যতক্ষণ না তা ঝড়ে পরিণত হচ্ছে, এন শ্রীনিবাসন স্বেচ্ছা-অবসরে যেতে এতটুকু আগ্রহী নন। রবিবার সকালে জেটলি এসে পড়ার পর সম্ভবত বিরোধীদের আর একপ্রস্ত বৈঠক-টৈঠক হবে। কিন্তু বিরোধীদের আস্কিং রেট যে তখন কুড়ি হয়ে যাবে। তখন উপায়? মানে রান করে জেতা যাবে না। আউট করে জিততে হবে।
আইপিএল ফাইনালে দু’দলের ব্যাটসম্যানরাই যে বলটা চাইবেন না, ঠিক তেমনই গুডলেংথ স্পট থেকে হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা একটা ডেলিভারি শ্রীনিবাসনের জন্য চাইছে তাঁকে হঠাতে চাওয়া জোট। আপ্রাণ কামনা যদি রোববারেই কোনও ভাবে সেটা আসে।
কিন্তু যতক্ষণ না তা আসছে, নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন ক্রিজে ব্যাট-প্যাড-হেলমেট সমেত থেকে যাচ্ছেন। চাপের মুখে তিনি, ধোনি আর সিএসকে-কে সমার্থক করার জন্য যেন পরিস্থিতিও তৈরি! ট্রফিটা শুধু হাতে নেওয়া বাকি! সরি, ট্রফিটা ধোনির হাতে শুধু তুলে দেওয়া বাকি। |