|
|
|
|
আইন-অমান্য ও পথজোড়া সভায় এ বার লাগাম |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
শহরে যত্রতত্র সভা-সমাবেশের জেরে জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়া রুখতে এ বার সক্রিয় হল রাজ্য সরকার। প্রথম দফায় তাদের সিদ্ধান্ত, কলকাতা পুলিশ এলাকায় কোনও আইন-অমান্য আন্দোলন চলবে না। শহরের কেন্দ্রস্থল, ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলে করা যাবে না কোনও সভা-সমাবেশও। শনিবার লালবাজারে সর্বদলীয় বৈঠকে কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ এই কথা জানিয়ে বলেন, উপযুক্ত পুলিশি পরিকাঠামো গড়ে না-ওঠা পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। তবে একই সঙ্গে তিনি জানান, পুলিশের অনুমতি নিয়ে শহরে রাজনৈতিক দলগুলি মেট্রো চ্যানেল বাদে অন্যত্র মিছিল ও সভা করতে পারবে। বিরোধী দলগুলি এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেছে। হাইকোর্টের নির্দেশে দীর্ঘদিন হল, এসপ্ল্যানেড-ইস্টে সভা-সমাবেশ বন্ধ।
তৃণমূল, কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি, এসইউসিআই, আরএসপি-সহ ১১টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে এ দিন বৈঠক করেন পুলিশ কমিশনার। ১১টি দলের মধ্যে ন’টি দলই এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। তৃণমূল নেতা মুকুল রায় এবং এনসিপি-র অমিয় সরকার এই নির্দেশের বিরোধিতা করেননি।
রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এ দিন হাজরায় দলীয় সভায় বলেন, “এরা বলেছিল, এখানে (হাজরায়) সভা করতে দেবে না। সভা করতে না পারলে কি আমি বাড়ি চলে যেতাম? কী ভাবছেন? সরকারকে বলছি, ও পথে যাবেন না। এ সব চিন্তাভাবনা ভাল নয়। তৃণমূল সভা করতে পারবে, আর কেউ করলে অসুবিধা হবে, এটা হয়? আজকেই আবার সরকার ফতোয়া জারি করেছে, আইন-অমান্য করতে দেবে না। আরে কে ওদের কথা শোনে! ওদের কথা অমান্য করে আইন ভাঙার জন্যই ৩১ মে আন্দোলন হবে।” বুদ্ধবাবুর দাবি, তাঁদের সময়ে কখনওই সভা বা আইন-অমান্য নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি যে, একটি দল করতে পারবে, অন্য দল পারবে না। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও জানান, “এ রকম বেআইনি ফতোয়া দেওয়ার অধিকার সরকার বা পুলিশ-প্রশাসনের নেই। আন্দোলনের পথেই আমরা এর বিরোধিতা করব।” |
|
মেট্রো চ্যানেলে জনসভার জেরে পথের হাল। —ফাইল চিত্র |
বুদ্ধবাবুর সভার জন্য হাজরা মোড় কেন্দ্র করে কিছুটা এলাকায় স্বাভাবিক কারণেই যানবাহন পেতে দুর্ভোগে পড়েন মানুষ। নজরুল মঞ্চ থেকে ফেরার পথে তা দেখে তৎক্ষণাৎ পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নির্দেশ দেন, “রাস্তার এক দিক দিয়ে অবিলম্বে গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা করুন।” তাঁর সেই নির্দেশে কাজ হয়।
সিপিএম এবং বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ, সামনেই তাঁদের আইন-অমান্য কর্মসূচি রয়েছে। সেই কর্মসূচি বানচাল করতেই সরকার পুলিশকে দিয়ে ফরমান জারি করাচ্ছে। প্রধান বিরোধী দল সিপিএম জানিয়েছে, আইন-অমান্য আন্দোলন নিয়ে কলকাতা পুলিশের এই সিদ্ধান্ত তারা মানছে না। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব বলেন, “লগ্নি সংস্থাগুলির অবৈধ কাজকর্মের প্রতিবাদে আগামী ৩১ মে রাজ্য বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে রানি রাসমণি রোডে আইন-অমান্য কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সেই কর্মসূচি হবে।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “সরকারের এই আদেশ মানব না। যখন আইন-অমান্যের দরকার, তখন করব।” প্রসঙ্গত ১ জুন বিজেপির আইন-অমান্য কর্মসূচি রয়েছে।
তবে সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশ জনজীবন বিপর্যস্তকারী এই ধরনের কর্মসূচি বন্ধ হওয়ার পক্ষে। লালবাজারের এক কর্তা জানান, ২ এপ্রিল ডিওয়াইএফ-এর আইন-অমান্য আন্দোলন ছিল রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে। আইন অমান্যকারীদের গ্রেফতার করে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যাওয়ার সময়ে পুলিশি হেফাজতে মারা যান এসএফআই নেতা সুদীপ্ত গুপ্ত। তার পরে ১৪ এপ্রিল এসইউসি-র ছাত্র-যুব সংগঠনের আইন অমান্যকারীদের হাতে মার খেয়ে গুরুতর জখম হন পুলিশের এক সাব ইনস্পেক্টর। এই সমস্ত ঘটনা পর্যালোচনা করে আপাতত রাজনৈতিক দলের ওই ধরনের কর্মসূচি বন্ধ রাখার প্রস্তাব দিয়েছে পুলিশ। বৈঠক শেষে পুলিশ কমিশনারও জানান, কলকাতা পুলিশের বর্তমান পরিকাঠামোয় আইন-অমান্য আন্দোলন সামাল দেওয়ার ক্ষমতা নেই। কলকাতা শহরে এই ধরনের আন্দোলন হলে জনজীবন বিপর্যন্ত হয়। ট্রাফিক ব্যবস্থার উপরেও তীব্র চাপ পড়ে। আইন অমান্যকারীদের গ্রেফতার করে জেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক বাস নিতে হয়। তাতে জনসাধারণের অসুবিধা হয়। কমিশনার বলেন, “পুলিশ তার নিজস্ব পরিকাঠামো গড়ে না তোলা পর্যন্ত আপাতত আইন-অমান্য আন্দোলন বন্ধ থাকবে।” আপাতত বলতে কত দিন বোঝাচ্ছে, তা অবশ্য পুলিশ কমিশনার জানাননি।
মেট্রো চ্যানেলে সভা-সমাবেশ হলে নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত হওয়ার পুলিশি যুক্তি সমর্থন করে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “মেট্রো চ্যানেলে যেখানে সমস্ত দল সভা করত, সেখানে বুদ্ধবাবুদের আমলেই পুলিশের বুথ করা হয়। ফলে, রাস্তার উপরে মঞ্চ বেঁধে সভা করলে যান চলাচল ব্যাহত হয়। মানুষের অসুবিধার কথা ভেবেই পুলিশ আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে।” তবে আইন-অমান্য কর্মসূচিকে রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক অধিকার জানিয়ে মুকুলবাবু বলেন, “সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। এই সময়ে আইন-অমান্যের মতো আন্দোলন স্থগিত রাখা উচিত, বা করলেও পুলিশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই তা করা উচিত।” কিন্তু ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ যেমন ধর্মতলায় হয়, তা হবে বলেই মুকুলবাবু জানান।
পুলিশের নির্দেশের সঙ্গে সহমত নয় কংগ্রেস। বৈঠকে সে কথা জানিয়ে এসেছেন কংগ্রেস নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “কংগ্রেসের নেতৃত্বেই দেশে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়। সারা দেশে শান্তিপূর্ণ আইন-অমান্য সিদ্ধ। সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতাতেও আইন-অমান্য হবে। আশা করি, পুলিশ কমিশনার তাঁর প্রস্তাব ফিরিয়ে নেবেন।”
রবীনবাবু এই প্রসঙ্গে বলেন, “মেট্রো চ্যানেলে একেবারেই সভা সমাবেশ করা যাবে না, এমন কথা কিন্তু পুলিশ কমিশনার বৈঠকে বলেননি। তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন। বিকল্প কোন জায়গায় সভা করা যেতে পারে, সেই ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলিও চিন্তাভাবনা করছে। আমরা বলেছি, শহিদ মিনার চত্বরকে সভা সমাবেশের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে।” বৈঠকে উপস্থিত বামফ্রন্ট শরিক-সহ অন্য সব দলই পুলিশি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হয়। |
নানা মত |
|
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় |
আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হলে তো ক্ষতি নেই, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইন-অমান্য আন্দোলন মারমুখী, হিংসাত্মক হয়ে যায়। এতেই আমাদের ভয়। সে ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করলে শুভ ফলই পাওয়া যাবে। তা ছাড়া, বাঙালি আন্দোলন নিয়ে বেশি মাথা ঘামাচ্ছে, কর্মসংস্কৃতি চুলোয় যাচ্ছে। এই রকম আন্দোলন বন্ধ হলেই ভাল। |
|
বাণী বসু |
|
যখন আমরা পরাধীন ছিলাম, তখন আইন-অমান্য আন্দোলন দরকার ছিল। এখন এ সবের প্রয়োজন নেই। আর মেট্রো চ্যানেলে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গে বলতে পারি, অতীতে বেশ কয়েক বার তো একই ঘোষণা হল। যারা ঘোষণা করল, তারাই আবার সেখানে সভা করল! এর পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, দেখতে হবে। |
|
|
সুমন মুখোপাধ্যায় |
মেট্রো চ্যানেলে সভা-সমাবেশের জেরে যানজট এবং সেই সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্স বা অফিসযাত্রীদের অসুবিধার কারণ না হয় বোঝা গেল। কিন্তু কলকাতায় আইন-অমান্য আন্দোলন নিষিদ্ধ করাটা তো অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক! এর পিছনে রাজ্য সরকার যদি জনজীবন বিপর্যন্ত হওয়া কারণ দেখায়, তা-ও বলব, কিছু কিছু বিষয়ে আইন-অমান্য করাটা জরুরি। |
|
পবিত্র সরকার |
|
আইন-অমান্য আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা হাস্যকর, অবৈধ, অগণতান্ত্রিক। আইন-অমান্য এক সময়ে মহাত্মা গাঁধী করেছেন। এটা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের অন্যতম হাতিয়ার ছিল। জনজীবন বহু কারণেই বিপর্যস্ত হতে পারে। আমার মনে হয়, জনসাধারণ একে নিজেদের জীবনের অঙ্গই মনে করে। |
|
|
প্রণবকুমার গুপ্ত (সুদীপ্ত গুপ্তের বাবা) |
আজ আইন-আমান্য আন্দোলন নিষিদ্ধ করলে কি আমার সুদীপ্ত ফিরে আসবে? আমার মনের ব্যথা কমবে? |
|
সুচিত্রা ভট্টাচার্য |
|
মেট্রো চ্যানেলে সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত ভাল। এতে যানযট অনেকটা এড়ানো যাবে। জনগনের সুবিধা হবে। কিন্তু শাসকদলকে খেয়াল রাখতে হবে, নিষেধাজ্ঞা যেন শুধু বিরোধীদের জন্য বলবৎ না হয়। শাসকদলকেও তা মানতে হবে। আর আইন-অমান্য আন্দোলন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক। আইন থাকলে অমান্য হবেই। |
|
|
|
|
|
|
|