পুস্তক পরিচয় ১...
মেধাবী পণ্ডিতের জীবনচর্যা
সানলাইট অন দ্য গার্ডেন/ আ স্টোরি অব চাইল্ডহুড অ্যান্ড ইউথ, আঁদ্রে বেতেই। পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া, ৪৯৯.০০
কটা কঠিন কাজের দায়িত্ব নিয়েছি; ভারতের বর্তমান প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক আঁদ্রে বেতেই-এর আত্মকথা-র আলোচনা লিখতে রাজি হয়েছি। আঁদ্রে আমার পুরনো বন্ধু, গবেষণার কাজে যখন সমাজশাস্ত্রের অন্তত অ আ ক খ শেখার প্রয়োজন হয়েছে, তখন যে দুই ব্যক্তি আমাকে ওই বিষয়ের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় হতে সাহায্য করেছেন, আঁদ্রে তাঁদের এক জন। আমার আত্মকথায় লিখেছি যে, দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের ডাকসাইটে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ও বিদ্যায় নিতান্ত অজ্ঞ আমি যখন হাঁসফাঁস করছি, তখন কয়েক জন সহকর্মীর সাহচর্য জীবন সহনীয় করেছিল। আঁদ্রে তাঁদেরও এক জন। এ ধরনের ঘনিষ্ঠতা আত্মজীবনীর সমালোচনা লেখার কাজটা সহজ করে না। একমাত্র সুবিধা এই যে বইটির বিষয়বস্তু আমার সঙ্গে আঁদ্রের যে সময় পরিচয় তার আগের যুগ। দিল্লি স্কুলে আঁদ্রে যে দিন যোগ দিলেন সেই দিনটিই এই বইটির সমাপ্তির তারিখ।
যে শৈশব ও যৌবনের কাহিনি এই বইয়ের উপজীব্য, তার পটভূমি তিনটি শহর: ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর, পটনা এবং কলকাতা। ন’বছর বয়স পর্যন্ত আঁদ্রে বাড়িতে পড়াশোনা করেছেন অনেকটা ফরাসি বাবার কাছে, যিনি ওঁকে ইংরেজি শিখতে বিশেষ উৎসাহ দিয়েছেন এবং ওই ভাষায় বইয়ের যে বিরাট সম্ভার তাতে আত্মনিয়োগ করতে। এই গৃহশিক্ষা একপেশে হলেও অবজ্ঞা করার মতো নয়। ন’বছর বয়সে আঁদ্রেকে পটনার এক বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হল, ওঁর দুই বড় ভাইও সেখানকার ছাত্র, ছাত্র ও শিক্ষক অধিকাংশ ফিরিঙ্গি, ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব কিছু প্রবল, জীবনযাত্রা একঘেয়ে, বিদ্যার্জন যা হয় তা নিতান্ত হেলাফেলা করার মতো নয়। কিন্তু আহার্যে নিকৃষ্টতা এবং নিয়মকানুনের কড়াকড়ি শৈশবের এই অন্ত্য এবং কৈশোরের এই প্রারম্ভকালকে আনন্দময় করে তোলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
পটনার বোর্ডিং স্কুল ছেড়ে কলকাতায় ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে পড়তে এবং রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে ডাক্তার সুন্দরীমোহন দাসের বাড়িতে থাকতে যখন বেতেই-রা চন্দননগর ছেড়ে উঠে এলেন (যদিও শহরটির সঙ্গে সম্পর্ক কখনওই ওঁদের ছিন্ন হয়নি), তখন আঁদ্রের বয়স বছর এগারো, কিন্তু ওঁর ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে মনে হয়।
এখানে ওঁর পারিবারিক জীবন বিষয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। ওঁর বাবা, মরিস বেতেই শৈশবে পিতৃহীন হয়ে স্কুলশিক্ষিকা মায়ের দ্বারা দারিদ্রের মধ্যে মানুষ হন। পরে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনে মাঝারি গোছের এক চাকরি তাঁর জীবনধারণের রসদ জোগায়। কী সূত্রে তাঁর বাঙালি ব্রাহ্মণ মহিলার সঙ্গে পরিচয়, প্রণয় এবং বিবাহ হয়, সে বিষয়ে আঁদ্রে নীরব। মহিলা তেজি গাঁধীবাদী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই আদর্শেরই সেবায় জীবন উৎসর্গ করেন। মৃদুভাষী নরম মেজাজের মানুষ মরিস ইয়োরোপীয় সাম্রাজ্যের সভ্যতাবিস্তারী ভূমিকায় বিশ্বাসী ছিলেন। এই বিবাহ স্বামী-স্ত্রীর মনের মিলে ঋদ্ধ হয়নি, যদিও কোনও প্রকট কলহ পারিবারিক শান্তির হানি করেনি।
ব্রাহ্মণ এবং ফরাসি এই দুই দিদিমার কাছে আঁদ্রের শৈশব কেটেছে। ফরাসি দিদিমা যে স্কুলে পড়াতেন সেখানেই বসবাস করতেন। কিন্তু জাতীয়তাবাদী মায়ের ব্যবস্থায় আঁদ্রে খাঁটি বাঙালি ভাবেই মানুষ হয়েছেন।
ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুল এবং ডাক্তার সুন্দরীমোহন দাসের বাড়ি— বাঙালি সমাজ সংস্কৃতিতে এই প্রবেশ আরও ঘনীভূত হল। একমাত্র ব্যতিক্রমী প্রভাব ক্যাথলিক ধর্ম দীক্ষা। যিনি এই দীক্ষাদান করেন সেই পাদরি সাহেবের নামেই আঁদ্রের নামকরণ। কিন্তু দীক্ষাটা যে অন্তরে প্রবেশ করেনি তার অন্যতর প্রমাণ ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে সরস্বতী পুজোয় আঁদ্রের কেন্দ্রীয় ভূমিকা। এখানে একটু খটকা লেগেছিল। ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলের ধর্মিষ্ঠ হেডমাস্টারমশাই এই ঘোর পৌত্তলিক ব্যাপারে উৎসাহ জোগালেন কী করে? মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘোর হিন্দু সংস্কৃতি খোল-করতাল বাজিয়ে দেবদেবীর পুজোতে যে আনন্দ পেত, চোখ বুজে পরব্রহ্মের আরাধনায় সেই সুখ সম্ভব না।
ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে আঁদ্রে সেরা ছাত্র বলে স্বীকৃতি পেলেন এবং ভবিষ্যৎ জীবনের উচ্চাশা এই সময়েই ওঁর মনে স্পষ্ট রূপ নিল। উনি শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার জগৎ নিজে কর্মক্ষেত্র রূপে বেছে নিলেন। ঠিক করলেন বৈজ্ঞানিক হবেন। এবং এই উদ্দেশ্যেই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হলেন। সেখানে ইয়োরোপীয় ফাদারদের জ্ঞান এবং কর্মনিষ্ঠা ওঁকে মুগ্ধ করল। কিন্তু এক ব্যাপারে নিরাশ হতে হল। উনি বুঝলেন, বিজ্ঞানে ওঁর মতি নেই, সুতরাং আই এস সি পাশ করার পর উনি অন্য পথ খুঁজতে লাগলেন।
এর মধ্যে সেন্ট জেভিয়ার্সে দু’বছর ওঁকে বাঙালি মধ্যবিত্তের পাশ্চাত্য অংশে প্রবেশপথ খুলে দিল। তুলনায় খোলামেলা, বিশেষ করে স্ত্রী-পুরুষের মেলামেশার ব্যাপারে, এই পাশ্চাত্যপ্রভাবিত সমাজ ওঁর খারাপ লাগেনি। হয়তো কোথাও একটু রোমান্সের ছোঁয়াও ছিল, তবে উনি সে ব্যাপারে সোচ্চার হননি। বৈজ্ঞানিক হওয়ার উচ্চাশা উনি রাতারাতি বিসর্জন দেননি। তার পথ খুঁজতে উনি গেলেন বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে। সেখানে ওঁর নৃতত্ত্ব এবং নৃতাত্ত্বিকদের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। এই জ্ঞানকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নির্মল বসু, কে পি চট্টোপাধ্যায়, এবং সুসঙ্গের রাজকুমার সুরজিৎ সিংহ। এঁদের উৎসাহে উনি নৃতত্ত্ব তথা সমাজতত্ত্বে পাঠ নিলেন। উক্ত বিষয়ে বি এসসি, এম এসসি পাশ করে আধা বেকার গবেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। সে অবস্থা থেকে প্রথম মুক্তি পেলেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে সার্ভেয়ারের কাজে যোগ দিয়ে। অধ্যাপক মহলানবিশ তখন প্রতিভাবান তরুণদের নিয়ে তাঁর নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ব্যস্ত। সামাজিক পরিবর্তনের হিসেব করা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। আঁদ্রে এই কাজে যোগ দিলেন কলকাতা এবং গিরিডিতে তাঁদের কর্মক্ষেত্র, পরিচালক রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, এঁর বিষয়ে আঁদ্রে শ্রদ্ধার সঙ্গেই লিখেছেন।
স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকেই আঁদ্রে দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সে অধ্যাপক শ্রীনিবাস পরিচালিত সদ্য স্থাপিত সমাজতত্ত্ব বিভাগে লেকচারারের পদে স্থায়ী চাকরি নিয়ে চলে আসেন। সেখানে কলেজে পড়ার সময় পরিচিত কলকাতার তিন বিখ্যাত ছাত্র অমর্ত্য, সুখময় আর পার্থসারথির সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ। অমর্ত্যর ক্ষুরধার বুদ্ধি, সুখময়ের অসাধারণ পাণ্ডিত্য, পার্থর গভীর বিদ্যানুরাগ ওঁকে ছাত্র অবস্থায়ই মুগ্ধ করেছিল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে এঁদের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। এঁদের মধ্যে সুখময়ের সঙ্গে কফি হাউসের আড্ডায় ওঁর আগে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছিল। আঁদ্রের সিদ্ধান্ত: অমর্ত্য ওঁদের প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী, সুখময় শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। পরে অমর্ত্য ওঁকে বলেন, এই মত প্রকাশে সুখময়ের প্রতি সুবিচার করা হয়নি।
দিল্লি স্কুলে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ওঁর স্মৃতিকথায় দাঁড়ি টেনে আঁদ্রে পাঠকের প্রতি অবিচার করেছেন। ভারতের শিক্ষাজগতে এই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানটিতে ওঁর অভিজ্ঞতা আমাদের বৌদ্ধিক ইতিহাসে মূল্যবান সম্পদ হয়ে থাকত। আঁদ্রেকে যাঁরা চেনেন তাঁরা ওঁর কৌতুকবোধকে বিশেষ মূল্য দেন। এই রচনায় সেই অনবদ্য কৌতুকবোধের প্রকাশ প্রায় নেই। তার বদলে আছে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের নানা স্তর নিয়ে বিশ্লেষণী আলোচনা, যা অতি মূল্যবান। তার চেয়েও মূল্যবান এক অত্যন্ত মেধাবী পণ্ডিতের জীবনচর্যা তথা আত্ম-আবিষ্কার এবং আত্মবিকাশের অনবদ্য ইতিহাস।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.